প্রতীকী ছবি

ইসলাম পূর্ব যুগে এবং মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত আল্লাহতে অবিশ্বাসী অমুসলিমরা মক্কার মসজিদুল হারামে প্রবেশ করতো এবং তাদের নিয়মে বায়তুল্লাহর সামনে ইবাদত করতো। আবার অনেক বিধর্মী ব্যবসায়ী হেরেম শরিফের সীমানায় প্রবেশ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ করতো। আল্লাহ তায়ালা মসজিদুল হারামে তাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার নির্দেশ দিয়ে পবিত্র কোরআনের সূরা তাওবার ২৮ নম্বর আয়াত নাজিল করেন।

বর্ণিত হয়েছে,

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡمُشۡرِکُوۡنَ نَجَسٌ فَلَا یَقۡرَبُوا الۡمَسۡجِدَ الۡحَرَامَ بَعۡدَ عَامِهِمۡ هٰذَا ۚ وَ اِنۡ خِفۡتُمۡ عَیۡلَۃً فَسَوۡفَ یُغۡنِیۡکُمُ اللّٰهُ مِنۡ فَضۡلِهٖۤ اِنۡ شَآءَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ

 

হে ঈমানদারগণ, মুশরিকরা তো অপবিত্র; কাজেই এ বছরের পর তারা যেন মসজিদুল হারামের ধারে-কাছে না আসে। আর যদি তোমরা দারিদ্রের আশংকা কর তবে আল্লাহ্ ইচ্ছে করলে তার নিজ করুণায় তোমাদেরকে অভাবমুক্ত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবা, (৯), আয়াত, ২৮)

আয়াতে উল্লেখিত হারাম শরিফের সীমানা কতটুকু?

মসজিদুল হারাম বলতে সাধারণত বোঝানো হয়, বায়তুল্লাহ শরিফের চতুর্দিকের আঙিনাকে, যা দেওয়াল পরিবেষ্টিত। তবে কোরআন ও হাদিসের কোনো কোনো স্থানে তা মক্কার পূর্ণ হেরেম শরিফ অর্থেও ব্যবহৃত, যা কয়েক মাইল এলাকা ব্যাপী, যারা সীমানা চিহ্নিত করেছেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। 

ইমামদের ঐকমত্যে এখানে মসজিদুল হারাম অর্থ শুধু বায়তুল্লাহর আঙিনা নয়। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিরাজ শুরু হয়েছিল হজরত উম্মে হানী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার ঘর থেকে, যা ছিল বায়তুল্লাহর আঙিনার বাইরে, কিন্তু নবীজির মিরাজের বর্ণনার ক্ষেত্রে এই অংশকেও মসজিদুল হারামের অন্তর্ভক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কোন বছর থেকে অমুসলিমদের মসজিদুল হারামে প্রবেশ নিষেধ?

আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এ বছরের পর তারা যেন মসজিদুল হারামের ধারে-কাছে না আসে’- এখানে এ বছর বলতে কোন বছর বুঝানো হয়েছে এ ব্যাপারে মুফাসসিরদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, দশম হিজরিতে। 

তবে অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে তা নবম হিজরিতে। কারণ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবম হিজরিতে হজের মৌসুমে হজরত আলী ও আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা এর মাধ্যমে কাফিরদের সাথে সর্ম্পকচ্ছেদের কথা ঘোষণা করান। তাই নবম হিজরি থেকে দশম হিজরি পর্যন্ত ছিল অবকাশের বছর। দশম হিজরির পর থেকেই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।

অমুসলিমদের কেন অপবিত্র বলা হয়েছে?

সূরা তাওবার এই আয়াতে মুশরিকদের ক্ষেত্রে নাজাস শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, অপবিত্রতা, পঙ্কিলতা যার প্রতি মানুষের ঘৃণা জন্মে।

মুশরিকদের ভেতরে কোন ধরনের অপবিত্রতা রয়েছে?- এ ক্ষেত্রে মুফাসসিররা বলেন,  মুশরিকদের শরীরে সাধারণত তিন ধরনের অপবিত্রতা থাকে। 

>>তারা দৃশ্যমান অনেক অপবিত্র বস্তুকে অপবিত্র মনে করে না। যেমন, মাদক দ্রব্য। 

>> আবার তারা অদৃশ্য অপবিত্রতাকেও বিশ্বাস করে না। যেমন, স্ত্রী সঙ্গম ও হায়েজ-নেফাসের পরের অপবিত্র অবস্থা। এজন্য এ অবস্থায় তারা গোসলকে আবশ্যক মনে করে না। 

>> একইভাবে তাদের ভেতরে থাকা ভ্রান্ত আকিদা ও বিশ্বাস, মন্দ স্বভাব ও আল্লাহর ওপর ঈমান না থাকার বিষটিকে তারা দোষণীয় মনে করে না। এসব কারণে তারা অপবিত্র এবং এই অপবিত্রতা নিয়ে তাদের মসজিদুল হারামে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

ইমাম মালেক রহ.-এর মতে...

তাফসিরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে, মদিনার ফিকাহশাস্ত্রবিদরা অর্থাৎ, ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহ ও অন্যান্য ইমামদের মতে মুশরিকরা যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকে অপবিত্র।

কারণ, তারা প্রকাশ্য অপবিত্রতা থেকে সতর্কতা অবলম্বন করে না। তেমনি জানাবতের গোসলেরও ধার ধারে না। একইভাবে কুফর-শিরকের বাতেনী অপবিত্রতা তো তাদের আছেই। সুতরাং সব মুশরিকের জন্য মসজিদুল হারামসহ অন্য সব মসজিদে প্রবেশ নিষেধ।

ওমর বিন আব্দুল আজিজ রহ.-এর সময়কাল

তাদের এই মতের সমর্থনে তারা হজরত ওমর বিন আব্দুল আজিজ রহিমাল্লাহর একটি ফরমানকে দলিল হিসেবে পেশ করেন।

ওমর বিন আব্দুল আজিজ রহিমাহুল্লাহ বিভিন্ন রাজ্যের প্রশাসকদের লিখেছিলেন, ‘মসজিদগুলোতে কাফেরদের প্রবেশ করতে দেবে না’। এ ফরমানে তিনি উপরোক্তি আয়তটির কথা উল্লেখ করেছিলেন।

ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহর দ্বিতীয় দলিল হলো আল্লাহর রাসূলের এই হাদিস। যেখানে তিনি বলেছেন, 

‘কোনো ঋতুবতী মহিলা বা জানাবত- যার জন্য গোসল ফরজ হয়েছে, তার পক্ষে মসজিদে প্রবেশ করাকে আমি জায়েজ মনে করি না’।

আর একথা সত্য যে, কাফির মুশরিকরা জানাবতের গোসল সাধারণত করে না। তাই তাদের জন্য মসজিদে প্রবেশ নিষিদ্ধ।

ইমাম শাফেয়ী রহ.

ইমাম শাফেয়ী রহিমাহুল্লাহ বলেন, কাফের-মুশরিক, আহলে কিতাব সবার জন্য মসজিদুল হারামে প্রবেশ নিষেধ। তবে তাদের জন্য অন্য মসজিদে প্রবেশ নিষেধ নয়।

ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতে...

ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর মতে মসজিদুল হারামের নিকটবর্তী না হওয়ার জন্য মুশরিকদের যে আদেশ দেওয়া হয়েছে, এর অর্থ হলো, তারা নিজ রীতি অনুযায়ী হজ ও ওমরা আর আদায় করতে পারবে না।

তবে ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর মতে, হজ ওমরা ছাড়া মুশরিকরা অন্য কোনো প্রয়োজনে আমিরুল মুমিনীনের অনুমতিক্রমে মসজিদূল হারামে প্রবেশ করতে পারবে।

এ মতের সমর্থনে তার দলিল হলো- মক্কা বিজয়ের পর সাকীফ গোত্রের প্রতিধিনিবৃন্দ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলেন। তখন তাদেরকে মসজিদের অবস্থান করানো হয়। অথচ তারা সবাই অমুসলিম ছিল। তাই সাহাবায়ে কেরাম আপত্তি তুলেছিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, এরা তো অপবিত্র। আল্লাহর রাসূল বললেন, মসজিদের মাটি এদের অপবিত্রতায় প্রভাবিত হবে না। (জাসসাস)।

এই হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায়, কোরআন শরিফে মুশরিকদের যে অপবিত্র বলা হয়েছে, তা তাদের কুফর ও শিরকজনিত বাতিনী (ভেতরগত) অপবিত্রতার কারণে।

ইমাম আবু হানিফা রহিমাল্লাহর বক্তব্যের সারকথা হলো- কোরআন ও হাদিসের মতে মসজিদগুলোকে অপবিত্রতা থেকে বিশুদ্ধ রাখা আবশ্যক এবং জরুরি।

আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ ও ওমর রা.-এর বাস্তবায়ন

তাফসিরে মাআরিফুল কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, সূরা তাওবার এই আয়াতে মুশরিকদের নবম হিজরির পর মসজিদুল হারামে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা জারির পর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দেন যে, গোটা আরব উপদ্বীপে কোনো কাফির মুশরিক থাকতে পারবে না। কিন্তু তিনি নিজে এ আদেশ কার্যকর করতে পারেননি।

বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সমস্যায় জড়িত থাকার কারণে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর পক্ষেও তা সম্ভব হয়নি। তবে হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার শাসনামলে আদেশটি যথাযথভাবে প্রয়োগ করেন।

ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সব অমুসলিমকে জাজিরাতুল আরব থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

বাণিজ্যিক কারণে অমুসলিমদের হেজাজে আসা-যাওয়া...

তবে বাণিজ্যিক কারণে অমুসলিম ব্যবসায়ীদের হেজাজে আসা-যাওয়া করার অনুমতি ছিল। কিন্তু তিন দিনের বেশি তাদের থাকতে দেওয়া হতো না।

জাজিরাতুল আরবের সীমানা দৈর্ঘ্যে হচ্ছে- এডেন বন্দর থেকে ইরাকের শস্যভূমি পর্যন্ত। আর প্রস্থে জেদ্দার সাগরোপকুল থেকে সিরিয়া পর্যন্ত।

(তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন, ৪/৩৪৫, তাফসিরে ইবনে কাসির, ৯/৬৭৩ তাফসিরে মাযহারী, ৫/২৮৭)