ওমর রা. শাসনকার্য শুরু করেছিলেন যেভাবে
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। তার শাসনামলে সর্বাধিক অঞ্চল মুসলমানদের অধীনে আসে। তিনি ইতিহাসে অর্ধজাহানের বাদশা হিসেবে পরিচিত। ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইসলাম গ্রহণ করেন ইসলামের প্রথম যুগে মক্কী জীবনে। যখন মুসলমানরা প্রতিনিয়ত মক্কার কাফেরদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন নারীপুরুষ মিলে মুসলমানের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪০ জন।
তিনি ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানেরা শক্তিশালী হন। এর আগে প্রকাশ্যে নামাজ পড়া হতো না, কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে মক্কার কাফেরদের ভয়ে তার ঈমানের কথা গোপন রাখতেন। কিন্তু ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সত্যের ব্যাপারে ছিলেন নির্ভীক। কাউকে ভয় করতেন না। ইসলাম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দেন এবং অন্য মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে কাফেরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাবার সামনে নামাজ আদায় করেন।
বিজ্ঞাপন
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কী জীবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ইসলাম গ্রহণ যেভাবে মুসলমানদের শক্তিশালী করেছিল ঠিক তেমনি তার শাসনকাল ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ।
ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ১৩ হিজরি থেকে ২৪ হিজরি মোতাবেক ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফার দায়িত্ব পালন করেন।
ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজের অন্তিম সময়ে মৃত্যুর পূর্বেই পরবর্তী খলীফা মনোনীত করে যাওয়াকে কল্যাণকর মনে করেছিলেন। তার দৃষ্টিতে ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন খিলাফতের যোগ্যতম ব্যক্তি।
তিনি আবদুর রহমান ইবন আউফ, উসমান ইবন আফফানসহ আরও বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাহাবির সঙ্গে আলোচনা করে ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে খলিফা নিযুক্ত করে ফরমান জারি করেন। তার সেই ফরমান লিখেছিলেন উসমান ইবনে আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। সেই ফরমানে লেখা হয়েছিল-
‘বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম। এটা আবু বকর ইবন আবী কুহাফার পক্ষ থেকে মুসলমানদের প্রতি অঙ্গীকার। আম্মাবাদ‘ আমি তোমাদের জন্য ’ওমর ইবনুল খাত্তাবকে খলীফা মনোনীত করলাম এবং এ ব্যাপারে তোমাদের কল্যাণ চেষ্টায় কোন ত্রুটি করি নাই’।
খেলাফত লাভের পর ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একটি ভাষণ দেন। সে ভাষণে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমি দুর্বল, আমাকে শক্তি দাও। হে আল্লাহ! আমি রূঢ় মেজাজি, আমাকে কোমলপ্রাণ বানাও। হে আল্লাহ! আমি কৃপণ, আমাকে দানশীল বানাও।’ (মানাকিবু আমিরুল মোমেনিন : ১৭০-১৭১, সীরাতু আমিরুল মোমেনিন ওমর ইবনুল খাত্তাব : ৭০)।
আরও পড়ুন
ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইতিহাসে শুধু একজন বিজেতা শাসক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন না, একই সঙ্গে তিনি ছিলেন জনদরদি। অসহায় দরিদ্রদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতেন। রাতে ছদ্মাবেশে জনগণের খবর খোঁজ-খবর নিতেন। তার সময়ে অনেক অঞ্চল বিজয় করেছিলেন মুসলিমরা।
বিভিন্ন অঞ্চল বিজয়ের পাশাপাশি তিনি তৎকালীন দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি রোমান ও পারসিক সাম্রাজ্যবাদকে পরাভূত করে তাদের সাম্রাজ্যকে ইসলামি রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত করেন এবং একটি কল্যাণমূলক প্রশাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সব অঞ্চলের ভারসাম্যমূলক উন্নয়ন ও অগ্রগতির নীতিমালাই ছিল প্রধান রাষ্ট্রীয় নীতি।
ইসলামি রাষ্ট্রের প্রকৃত অর্থ হলো, সরকারি সেবার পরিধি বাড়ানো যা হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর শাসনামলে পূর্ণরূপ বাস্তবায়িত হয়েছিল।
হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর খেলাফত আমলে যে সমস্ত দেশ, প্রদেশ ও অঞ্চল বিজিত হয়, সেগুলোর মধ্যে পারস্য, ইরাক, খুরাসান, বেলুচিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিসর, আর্মেনিয়া প্রভৃতি রয়েছে। তার দশ বছরের খেলাফত আমলে যে বিজয় অর্জিত হয়, তা ছিল অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য। শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে হিজরি ২২ সনে তিনি ইসলামি রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করেন।আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করেন।
ইতিহাসবিদদের বর্ণনা মতে তার খেলাফত বিস্তৃত ছিল মক্কা মুকাররমাহ, মদিনা মুনাওয়ারাহ, সিরিয়া, জাজিরা, বসরা, কুফা, মিসর, ফিলিস্তিন, খুরাসান, আজারবাইজান ও পারস্যজুড়ে।
এগুলোর মধ্যে কোনো কোনো প্রদেশের আয়তন ছিল দুটি প্রদেশের সমান। কোনো কোনো প্রদেশের আবার দু’দুটি কেন্দ্র ছিল এবং প্রত্যেকটি কেন্দ্রে পৃথক পৃথক কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিল। প্রত্যেক প্রদেশের, একজন ওলী বা কর্মকর্তা, একজন কাতিব (সচিব) বা মীর মুনশী, একজন সেনানায়ক, একজন সাহিবুল খারাজ বা কালেক্টর, একজন পুলিশ অফিসার, একজন ট্রেজারি অফিসার এবং একজন বিচারক অবশ্যই থাকত। এভাবে তার খেলাফত হয়ে উঠেছিল সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল। (তারিখুল ইসলাম আকবর শাহ নজিবাবাদি : ১/৩৫৩)।
ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার শাসনামলে হিজরি সাল প্রবর্তন, শহর নির্মাণ, ইবাদতখানা নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনে কাজ করেন।
(সীরাতু ইবন হিশাম, তারিখুল ইসলাম, যাহাবি : ৩/২৫৩, সীরাতু আমিরিল মোমেনিন ওমর ইবনুল খাত্তাব : পৃ.১২-১৩, তারিখে উম্মাতে মুসলিমা : ৩/৯২)
এনটি