প্রতীকী ছবি

আল্লাহ তায়ালা হজরত নূহ আলাইহিস সালামকে প্রায় ১ হাজfর বছরের বেশি জীবন দান করেছিলেন। একইসঙ্গে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান ও সুপথে পরিচালিত করার দায়িত্ব দিয়ে তাকে নবী বানিয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা নূহ আলাইহিস সালামকে নবী হিসেবে প্রেরণের বিষয়ে বলেছেন,

اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنَا نُوۡحًا اِلٰی قَوۡمِہٖۤ اَنۡ اَنۡذِرۡ قَوۡمَکَ مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ

 

নিশ্চয় আমি নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছিলাম (এই নির্দেশসহ যে,) তুমি তোমার সম্প্রদায়কে সতর্ক কর তাদের উপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আসার পূর্বে। (সূরা নূহ, (৭১), আয়াত, ১)

নূহ আ.-এর নবুওয়ত

নূহ আলাইহিস সালাম পুরো জীবন নিজ সম্প্রদায়ের মানুষদের আল্লাহর একত্ববাদরে দিকে আহ্বান করেছেন। কিন্তু তার সম্প্রদায়ের লোকজন নবীর কথায় সাড়া দেয়নি। উল্টো তার ওপর বিভিন্ন পন্থায় নির্যাতন করেছে, কখনো কখনো তাকে পাথর দিয়ে আঘাত করেছে। তাদের আঘাতে নূহ আলাইহিস সালাম অনেক সময় রক্তাক্ত এবং বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতেন। জ্ঞান ফিরলে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করে বলতেন, হে আল্লাহ আমার জাতিকে ক্ষমা করুন, তারা অজ্ঞ, মূর্খ, জানে না, বুঝে না।

পবিত্র কোরআনে নূহ আলাইহিস সালামের দাওয়াতের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে এভাবে-

قَالَ یٰقَوۡمِ اِنِّیۡ لَکُمۡ نَذِیۡرٌ مُّبِیۡنٌ ۙ ٢ اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ وَاتَّقُوۡہُ وَاَطِیۡعُوۡنِ ۙ ٣ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ مِّنۡ ذُنُوۡبِکُمۡ وَیُؤَخِّرۡکُمۡ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ اِنَّ اَجَلَ اللّٰہِ اِذَا جَآءَ لَا یُؤَخَّرُ ۘ لَوۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ٤  

 

তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্ককারী, এ বিষয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাঁর তাকওয়া অবলম্বন কর, আর আমার আনুগত্য কর,  তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন এবং তোমাদেরকে অবকাশ দেবেন। এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত।(২) নিশ্চয় আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত হলে তা বিলম্বিত করা হয় না; যদি তোমরা এটা জানতে! (সূরা নূহ, (৭১), আয়াত, ২-৪)

নূহ আ. যেভাবে নিজ সম্প্রদায়কে আল্লাহর পথে আহ্বান করতেন

তাদের সব নির্যাতন সয়ে তিনি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মকে আসমানী ধর্মের দিকে আহ্বান করে গেছেন শুধু এই আশায় যে হয়তো তাদের কোনো এক প্রজন্ম তার কথায় আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে।

তিনি তাদের ঈমানের প্রতি আগ্রহী করতে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন পুরস্কারের সুসংবাদ শুনিয়েছিলেন, ঈমান আনলে আল্লাহ তাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততিতে বরকত দেবেন, প্রয়োজনের সময় বৃষ্টিপাত করবেন বলেও জানিয়েছিলেন, বলেছিলেন, আল্লাহর ওপর ঈমান আনলে তোমরা পরকালে চিরস্থায়ী জান্নাত পাবে।

নূহ আলাইহিস সালাম তাদেরকে আসমান-জমিন, চাঁদ-সূর্যের সৃষ্টি নৈপূন্যের কথা স্মরণ করিয়ে এর স্রষ্টার ঈমান আনার কথা বলতেন। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, 

فَقُلۡتُ اسۡتَغۡفِرُوۡا رَبَّکُمۡ ؕ  اِنَّہٗ کَانَ غَفَّارًا ۙ ١۰ یُّرۡسِلِ السَّمَآءَ عَلَیۡکُمۡ مِّدۡرَارًا ۙ ١١ وَّیُمۡدِدۡکُمۡ بِاَمۡوَالٍ وَّبَنِیۡنَ وَیَجۡعَلۡ لَّکُمۡ جَنّٰتٍ وَّیَجۡعَلۡ لَّکُمۡ اَنۡہٰرًا ؕ ١٢ مَا لَکُمۡ لَا تَرۡجُوۡنَ لِلّٰہِ وَقَارًا ۚ ١٣ وَقَدۡ خَلَقَکُمۡ اَطۡوَارًا ١٤ اَلَمۡ تَرَوۡا کَیۡفَ خَلَقَ اللّٰہُ سَبۡعَ سَمٰوٰتٍ طِبَاقًا ۙ ١٥ وَّجَعَلَ الۡقَمَرَ فِیۡہِنَّ نُوۡرًا وَّجَعَلَ الشَّمۡسَ سِرَاجًا ١٦ وَاللّٰہُ اَنۡۢبَتَکُمۡ مِّنَ الۡاَرۡضِ نَبَاتًا ۙ ١٧ ثُمَّ یُعِیۡدُکُمۡ فِیۡہَا وَیُخۡرِجُکُمۡ اِخۡرَاجًا ١٨ وَاللّٰہُ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ بِسَاطًا ۙ ١٩ لِّتَسۡلُکُوۡا مِنۡہَا سُبُلًا فِجَاجًا ٪

বলেছি, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয় তিনি মহা ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন, এবং তিনি তোমাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন উদ্যান ও প্রবাহিত করবেন নদী-নালা। তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের পরওয়া করছ না! অথচ তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন পৰ্যায়ক্রমে। তোমরা কি লক্ষ্য করনি আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান স্তরে স্তরে বিন্যস্ত করে। তিনি তোমাদেরকে উদ্ভূত করেছেন মাটি হতে। তারপর তাতে তিনি তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেবেন এবং পরে নিশ্চিতভাবে বের করে নিবেন। আর আল্লাহ তোমাদের জন্য যমীনকে করেছেন বিস্তৃত।  যাতে তোমরা সেখানে চলাফেরা করতে পার প্রশস্ত পথে। (সূরা নূহ, (৭১), আয়াত, ১০-২০)

নূহ আ.-এর ঈমানের দাওয়াতে যা করত অবিশ্বাসীরা


কিন্তু শতা্ব্দীর পর শতাব্দী প্রাণপণ চেষ্টা করেও নূর আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় আল্লাহ তায়ালার ওপর ঈমান আনেনি। নূহ আলাইহিস সালাম যখন তাদেরকে আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ ও নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে আল্লাহর ওপর ঈমান আনার কথা বলতেন তখন তারা দৌঁড়িয়ে পালাতো এবং নিজেদের কানে আঙ্গুল দিয়ে রাখতো। তখন নূহ আলাইহিস সালাম অপরগতা প্রকাশ করে আল্লাহ তায়ালার কাছে ফরিয়াদ করে বললেন, 

قَالَ رَبِّ اِنِّیۡ دَعَوۡتُ قَوۡمِیۡ لَیۡلًا وَّنَہَارًا ۙ ٥ فَلَمۡ یَزِدۡہُمۡ دُعَآءِیۡۤ اِلَّا فِرَارًا ٦

 

নিশ্চয় আমি আমার জাতি দিন-রাত দাওয়াত দিয়েছি। কিন্তু আমার দাওয়াত তাদের শুধু সত্য পথ থেকে পলায়ন প্রবণতাই বৃদ্ধি করেছে। (সূরা নূহ, (৭১), আয়াত, ৫-৬) 

যে কারণে নূহ আ.-এর কথা মানতো না তারা

হজরত নূহের আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় আল্লাহর ওপর ঈমান না আনার কারণ ছিল মূলত তাদের মূর্তিপূজা।

নূহ আলাইহিস সালামের পূর্বপুরুষের মধ্যে পাঁচজন বিখ্যাত সাধক পুরুষ ছিলেন। তাদের নাম ছিল ‘ওয়াদ’, ‘সুয়া’, ‘ইয়াগুস’, ‘ইয়াউক’ ও ‘নাসর’। তাদের ইন্তেকালের পর সম্প্রদায়ের লোকেরা স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাদের প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য স্থাপন করে। এরপর কেটে যায় যুগের পর যুগ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সেই ভাস্কর্য কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে নানা কল্পনা তৈরি হয়।

শয়তান তাদের সেই কল্পনার পালে হাওয়া দেয়। মানুষকে প্ররোচনা দেয় এসব ভাস্কর্য তোমাদের খোদারই আকৃতি। সুতরাং তোমরা এগুলোর সামনে নত হও, এদের সিজদা করো। 

যুগ-যুগান্তের পালাবদলে সাধকপুরুষদের ভাস্কর্য কেন্দ্র করে সূত্রপাত হয় মূর্তি পূজার। আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে ধীরে ধীরে গোটা সম্প্রদায়ের লোকেরা মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়ে যায়। 

কোরআনে নূহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের মূর্তি পূজার ঘটনার বিবরণ এসেছে এভাবে, 

قَالَ نُوۡحٌ رَّبِّ اِنَّہُمۡ عَصَوۡنِیۡ وَاتَّبَعُوۡا مَنۡ لَّمۡ یَزِدۡہُ مَالُہٗ وَوَلَدُہٗۤ اِلَّا خَسَارًا ۚ ٢١ وَمَکَرُوۡا مَکۡرًا کُبَّارًا ۚ ٢٢ وَقَالُوۡا لَا تَذَرُنَّ اٰلِہَتَکُمۡ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَّلَا سُوَاعًا ۬ۙ  وَّلَا یَغُوۡثَ وَیَعُوۡقَ وَنَسۡرًا ۚ ٢٣ وَقَدۡ اَضَلُّوۡا کَثِیۡرًا ۬ۚ وَلَا تَزِدِ الظّٰلِمِیۡنَ اِلَّا ضَلٰلًا ٢٤ مِمَّا خَطِیۡٓــٰٔتِہِمۡ اُغۡرِقُوۡا فَاُدۡخِلُوۡا نَارًا ۬ۙ فَلَمۡ یَجِدُوۡا لَہُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اَنۡصَارًا ٢٥

নূহ বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় তো আমাকে অমান্য করেছে এবং অনুসরণ করেছে এমন লোকের যার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তার ক্ষতি ব্যতীত আর কিছুই বৃদ্ধি করেনি। আর তারা ভয়ানক ষড়যন্ত্র করেছে। এবং বলেছে, তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে; পরিত্যাগ করো না ওয়াদ, সুওয়া’আ, ইয়াগূছ, ইয়াউক ও নাসরকে। বস্তুত তারা অনেককে বিভ্রান্ত করেছে; কাজেই আপনি জালিমদের বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করবেন না।

তাদের অপরাধের জন্য তাদেরকে নিমজ্জিত করা হয়েছিল এবং পরে তাদেরকে প্রবেশ করানো হয়েছিল আগুনে, অতঃপর তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকেও সাহায্যকারী পায়নি। (সূরা নূহ, (৭১), আয়াত, ২১-২৫) 

আল্লাহর পক্ষ থেকে নৌকা তৈরির নির্দেশ

এভাবে নূহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের মানুষদের ঔদ্ধত্য বেড়ে যাওয়ায় আল্লাহ তায়ালা ঈমানদার ছাড়া বাকিদের সমূলে ধ্বংস করে দেন। তার আগে তিনি নূহ আলাইহিস সালামকে একটি নৌকা তৈরির নির্দেশ দেন। 

নৌকা দেখে ঠাট্টা

এতোদিন তার নূহ আলাইহিস সালামকে দাওয়াতের কাজে বাধা দিতো। এবার যখন তিনি নৌকা বানাতে আরম্ভ করেন তখনও সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে নানাভাবে তিরস্কার করতে লাগল। তারা বলত, হে নূহ! আশপাশে কোথাও তো নদীনালা নেই, তা হলে তুমি এই জাহাজ নির্মাণ করছ কেন? মাটিতেই কি জাহাজ চালাবে? তারা টিপ্পনি কেটে বলত, এতদিন ছিলে নবী, নবুয়তি ছেড়ে এখন হয়েছ কাঠমিস্ত্রি!

নূহ আলাইহিস সালাম তাদের কথায় কর্ণপাত না করে আল্লাহর নির্দেশ পালনে মনোনিবেশ এবং নৌকার নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন। অবশেষে একদিন শুরু হলো মহাপ্লাবন। আসমান থেকে মুষলধারে বৃষ্টি নামল, ভূমিতল থেকেও উতলে উঠল পানি। 

মহাপ্লাবন

নূহ আলাইহিস সালাম ঈমানদার মানুষ এবং জোড়া জোড়া প্রাণী নিয়ে নৌকায় চড়লেন। তার এক ছেলে ঈমানদার ছিল না। সেও প্লাবনে নিমজ্জিত হলো। তাকে রক্ষার জন্য শেষ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন হজরত নূহ (আ.)।

এই প্লাবনে নৌকার আরোহী ছাড়া পৃথিবীর সব প্রাণী মারা যায়। সবকিছু ধ্বংস হওয়ার পর আল্লাহর হুকুমে আসমানের বৃষ্টি থামে, জমিন পানি শোষণ করে নেয়। ঈমানদারদের দ্বারা পৃথিবী আবার নতুন করে আবাদ হয়। ফুল-পাখিতে ভরে ওঠে দুনিয়া। 

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,


 فَاَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡهِ اَنِ اصۡنَعِ الۡفُلۡکَ بِاَعۡیُنِنَا وَ وَحۡیِنَا فَاِذَا جَآءَ اَمۡرُنَا وَ فَارَ التَّنُّوۡرُ ۙ فَاسۡلُکۡ فِیۡهَا مِنۡ کُلٍّ زَوۡجَیۡنِ اثۡنَیۡنِ وَ اَهۡلَکَ اِلَّا مَنۡ سَبَقَ عَلَیۡهِ الۡقَوۡلُ مِنۡهُمۡ ۚ وَ لَا تُخَاطِبۡنِیۡ فِی الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا ۚ اِنَّهُمۡ مُّغۡرَقُوۡنَ

 ‘তুমি একটি নৌকা তৈরি করো। এরপর যখন আমার আদেশ আসবে এবং চুল্লি প্লাবিত হবে, তখন নৌকায় তুলে নেবে প্রত্যেক জীবের একেক জোড়া এবং তোমার পরিবারবর্গকে, তাদের মধ্যে যাদের বিপক্ষে পূর্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাদের ছাড়া। এবং তুমি জালেমদের সম্পর্কে আমাকে কিছু বলবে না। নিশ্চয় তারা নিমজ্জিত হবে।’ (সূরা মুমিনুন, (২৩), আয়াত, ২৭)

(সূরা হুদ, সূরা নূহ, সূরা মুমিনুন, তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন, ৪/৬০৩)