নতুন বছরে একজন মুসলিমের পরিকল্পনা যেমন হবে
আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে মানুষকে পাঠিয়েছেন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। নির্ধারিত সময় শেষে মানুষ যখন পরকালের জীবনের মুখোমুখি হবে তখন তার কাছে দুনিয়ার আরাম-বিলাসিতা মরিচিকার মতো মনে হবে। একইসঙ্গে দুনিয়ার জীবনকে এতোটাই এক সকাল অথবা বিকেলের মতো তুচ্ছ মনে হবে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,
کَاَنَّهُمۡ یَوۡمَ یَرَوۡنَهَا لَمۡ یَلۡبَثُوۡۤا اِلَّا عَشِیَّۃً اَوۡ ضُحٰهَ
বিজ্ঞাপন
যেদিন তারা তা দেখবে সেদিন তাদের মনে হবে, যেন তারা (পৃথিবীতে) এক সন্ধ্যা বা এক সকালের বেশি অবস্থান করেনি। ( সূরা নাযিয়াত, আয়াত, ৪৬)
পৃথিবীর এই জীবনে আল্লাহ তায়ালা নেয়ামত বোঝার জন্য আল্লাহ তায়ালা দিন-রাতের পরিবর্তন দিয়েছেন। দিনকে করেছেন কাজের সময়, রাতে বানিয়েছেন আরামের জন্য। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَ هُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ الَّیۡلَ وَ النَّهَارَ وَ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ ؕ کُلٌّ فِیۡ فَلَکٍ یَّسۡبَحُوۡنَ
‘তিনিই (আল্লাহ) যিনি সৃষ্টি করেছেন রাত, দিন, চন্দ্র ও সূর্য। এগুলোর প্রতিটিই নিজ নিজ কক্ষপথে নিজস্ব গতিতে পরিভ্রমণে নিয়োজিত।’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত, ৩৩)
দিন রাতের পরিবর্তন মানুষকে একদিন তার জীবনের নির্ধারিত সময়ে নিয়ে যাবে এবং তাকে চিরস্থায়ী ঠিকানায় পৌঁছিয়ে দেবে। এজন্য একজন মুমিন, মুসলিমের উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষণ পরকালের চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির কাজে ব্যয় করা। কারণ পরকালে সবাইকে তার নিজ নিজ কর্মফল অনুযায়ী প্রতিদান দেওয়া হবে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَ اِنَّ کُلًّا لَّمَّا لَیُوَفِّیَنَّهُمۡ رَبُّکَ اَعۡمَالَهُمۡ ؕ اِنَّهٗ بِمَا یَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرٌ
যখন সময় আসবে তখন অবশ্যই তোমার প্রতিপালক তাদের সবাইকে তার কর্মফল পুরোপুরিভাবে দেবেন। তারা যা করে, নিশ্চয়ই তিনি সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত। (সূরা হুদ, আয়াত, ১১১)
এজন্য নতুন বছর বা যেকোনো মুহুর্ত উন্মাদনায় না মেতে নিজের জীবনকে আমলের মাধ্যমে সাজানোর পরিকল্পনা উচিত। একজন মুসলিম বছরের শুরু থেকে যেভাবে নিজের আমলের পরিকল্পনা সাজাতে পারেন এখানে তুলে ধরা হলো-
ধর্মীয় বিষয়ে জানার চেষ্টা
অনেকেই দুনিয়াবি বিষয়-আশয় সম্পর্কে সবকিছু বুঝলেও এবং জানলেও ধর্মীয় বিষয়ে তাদের জানাশোনা একেবারে শূন্যের কোঠায়। কীভাবে নামাজ পড়তে হয়, নামাজের মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কেও জানাশোনা নেই কারো কারো। অনেকেই কোরআন শরিফও বিশুদ্ধভাবে পড়তে পারেন না।
ধর্মীয় বিষয়ে নিজের অজ্ঞতা দূর করতে বছরের শুরুতেই পরিকল্পনা করা উচিত। প্রতিদিন অল্প অল্প করে ধর্মীয় বিষয়ে জানার চেষ্টা করা উচিত। এজন্য বিভিন্ন বই পড়া ও আলেমদের সাহচর্য গ্রহণ করা যেতে পারে।
কোরআন তিলাওয়াতে ও বোঝার জন্য সময় ব্যয় করা
যারা কোরআন তিলাওয়াত করতে পারেন না, তাদের জন্য বছরের শুরুতেই পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিত, যেন এ বছরেই বিশুদ্ধভাবে কোরআন তিলাওয়াত শিখে যেতে পারি। প্রতিদিন অন্তত অল্প কিছূ সময়ের জন্য হলেও কোরআন খুলে বসা উচিত। এজন্য সকাল সন্ধ্যার যেকোনো একটি সময় নির্দিষ্ট করে নেওয়া যেতে পারে। মোবাইলে কুরআনের অ্যাপস ডাউনলোড করে কাজের ফাঁকে পড়া যেতে পারে। কোরআন পাঠ নিঃসন্দেহে আপনার মনে প্রশান্তি নিয়ে আসবে। চাইলে কিছু চমৎকার তেলাওয়াতও শুনতে পারেন নিয়ম করে।
একইভাবে নিয়মিত কিছু হাদিস পড়ার অভ্যাস করা। অন্তত একটি হাদিস হলেও যেন বুঝে পড়া যায়। বিভিন্ন আলেমের কাছ থেকে কোরআনের তাফসির জানা এবং শোনার পরিকল্পনাও রাখা নতুন দিনের আগমনে।
সময়মতো নামাজ আদায় এবং কখনো না ছাড়ার দৃঢ় পরিকল্পনা
নামাজের প্রতি মানুষের ব্যাপক অবহেলা রয়েছে। অথচ নামাজ না পড়ার শাস্তি জাহান্নাম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, কেয়ামতের দিন জাহান্নামীদের জিজ্ঞাসা করা হবে— ‘কেন তোমরা সাকার নামক জাহান্নামে এলে? তারা বলবে, আমরা তো নামাজি ছিলাম না এবং আমরা মিসকিনদের খাবার দিতাম না; বরং আমরা সমালোচনাকারীদের সঙ্গে সমালোচনায় নিমগ্ন থাকতাম। এমনকি আমরা প্রতিদান দিবসকে (কেয়ামত) অস্বীকার করতাম। আর এভাবেই হঠাৎ আমাদের মৃত্যু এসে গেল।’ (সূরা মুদ্দাসসির, আয়াত, ৩৮-৪৭)
প্রথম ওয়াক্তেই জামাতে নামাজ পড়া
যারা নামাজ পড়েন তাদের অনেকেই জামাতে নামাজ পড়া এবং প্রথম ওয়াক্তে নামাজ পড়ার প্রতি গুরুত্ব দেন না। কিন্তু এমনটা করা উচিত নয়। কারণ জামাতে নামাজ আদায়ের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। এক হাদিসে জামাতে নামাজ আদায়ের ফজিলত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়া একাকী নামাজ পড়ার চেয়ে ২৭ গুণ বেশি মর্যাদার।’ (বুখারি, হাদিস, ৬৪৫, মুসলিম, হাদিস, ৬৪০)
আরেক হাদিসে নবীজি সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমার প্রাণ যাঁর হাতে, তাঁর কসম করে বলছি! অবশ্যই আমি সংকল্প করেছি, আমি কাঠ সংগ্রহ করার নির্দেশ দেব, তারপর আমি নামাজের হুকুম দেব এবং এ জন্য আজান দেওয়া হবে, তারপর আমি এক ব্যক্তিকে হুকুম করব সে লোকদের নামাজ পড়াবে। এরপর আমি ওই লোকদের দিকে যাব, যারা জামাতে হাজির হয়নি। এবং তাদের বাড়িঘর তাদের সামনেই জ্বালিয়ে দেব।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস, ২৪২০)
অন্যায়-অপরাধ থেকে দূরে থাকার পণ
অনেকে নিজের অজান্তে অনেক অন্যায় ও অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। পরে চাইলেও ভালো পথে থাকতে পারে না। যেমন-কেউ একটা মিথ্যা বলল, এই মিথ্যাটা ঢাকবার জন্য তাকে আরও কয়েকটা মিথ্যা বলতে হয়। একটা দুর্নীতি করলে এটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য আরও কিছু দুর্নীতি করতে হয়। তাই এসব অন্যায়-অপরাধমূলক কর্ম থেকে বিরত থাকার নতুন পরিকল্পনা করা। যেন নতুন বছরে আমার দ্বারা এমন কিছু না ঘটে।
আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নেওয়া
আত্মীয়তার বন্ধন ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু অনেকেই আছে, বছর পার হয়ে গেলেও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কোনো দেখা-সাক্ষাৎ করে না বা খোঁজখবর নেয় না। এমন না করা। সম্ভব হলে প্রতি সপ্তাহে কিংবা মাসে আত্মীয়দের খবর নেওয়া। দুর্বল স্বজনদের সহায়তা করা।
আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা দেন, ‘আল্লাহতায়ালা সবার সঙ্গে ন্যায় ও সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিচ্ছেন এবং নির্দেশ দিচ্ছেন আত্মীয়স্বজনের হক আদায়ের জন্য।’ (সূরা নাহল, আয়াত, ৯০)
আরও পড়ুন
এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযা সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার রিজিক প্রশস্ত হওয়া এবং মৃত্যুর সময় পিছিয়ে দেয়া কামনা করে, তার উচিত আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা।’ (বুখারি)
অপর এক হাদিসে হজরত আবু আইয়ুব আনসারি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এমন আমল বলে দিন; যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর ইবাদত কর, তার সঙ্গে কোনো কিছু শরিক করো না। নামাজ ভাল করে আদায় কর এবং জাকাত দাও আর আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখ।’ (বুখারি)
নিয়মিত নফল আমলে মনোযোগী হওয়া
ফরজ আমলে ত্রুটি থাকলে কেয়ামতের দিন নফল আমল দিয়ে এর ঘাটতি পূরণ করা হবে। তাই প্রতিদিনের ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি কিছু নফল আমল করার পরিকল্পনাও রাখতে। নতুন বছরে নফল নামাজ, নফল রোজা, দান-সদকা ইত্যাদি আমল বেশি বেশি করার চেষ্টা করা।
এক হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন বান্দার সর্বপ্রথম হিসাব নেওয়া হবে তার সালাতের। যদি তার সালাতের হিসাব সঠিক হয় তাহলে সে সফলকাম হবে এবং নাজাত পাবে। আর যদি সালাত বিনষ্ট হয়ে যায় তাহলে সে বিফল ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যদি ফরজ সালাতে কিছু কমতি হয়, তাহলে আল্লাহ বলবেন, দেখো, আমার বান্দার কোনো নফল ইবাদত আছে কি না? তখন নফল দিয়ে ফরজের ঘাটতি পূরণ করা হবে। অতঃপর তার অন্য সব আমল সম্পর্কেও অনুরূপ করা হবে (যেমন : সালাত, সিয়াম, জাকাত, হজ ইত্যাদি)।
(আবু দাউদ, হাদিস, ৮৬৪)
মহানবী সা.-এর জীবনী সম্পর্কে জানা
একজন মানুষের প্রকৃত মুমিন হওয়ার শর্ত হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সব কিছুর থেকে বেশি ভালোবাসা। এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই বলেছেন,তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তার কাছে আমি তার পিতামাতার চেয়ে, সন্তানাদির চেয়ে এবং সমস্ত মানুষের চেয়ে প্রিয় না হবো। (বুখারি, হাদিস, ১৫)
বর্তমান সময়ে এসে রাসূলকে ভালোবাসা দূরে থাক, অনেকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী সম্পর্কেও জানেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অজ্ঞতা দূর করতে সিরাত বা প্রিয় নবীকে নিয়ে রচিত বইগুলো পাঠ করা জরুরি।
এনটি