প্রতীকী ছবি

কোনো মুসলমান মারা গেলে অপর মুসলমানের ওপর মৃতের গোসল, কাফন, জানাজা, জানাজা বহন ও দাফন করার অবশ্যক হয়ে যায়। কেউ মারা গেলে দ্রুতই এই কাজগুলো সম্পাদন করতে হয়। হাদিসে এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 

এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত আলী রা.-কে লক্ষ্য করে বলেন, ‘হে আলী! তিনটি জিনিসের ক্ষেত্রে বিলম্ব করবে না। ১. নামাজের যখন সময় আসবে তখন নামাজ আদায় করা থেকে দেরি করবে না। ২. মৃত ব্যক্তির জানাজা যখন উপস্থিত হবে তখন কাফন-দাফন সম্পন্ন করতে দেরি করবে না। ৩. কোন অবিবাহিতা মেয়ের জন্য যখন কোন উপযুক্ত পাত্র পাবে তখন তাকে পাত্রস্থ করা থেকে বিলম্ব করবে না।’ (তিরমিজি ১/২০৬)

হাবিল-কাবিল

মৃতকে দাফনের প্রচলন শুরু হয়েছিল হজরত আদম আলাইহিস সালামের দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে। ঘটনাটি হলো- 

হজরত আদম আলাইহিস সালাম ও হাওয়া আলাইহাস সালামের থেকেই পৃথিবীতে মানবজাতি বিস্তার লাভ করে। তাদেরকে বলা হয় আদিপিতা ও আদিমাতা। মুফাসসির ইবনে জারির (রহ.) বলেছেন, ‘হাওয়া আলাইহাস সালাম ২০ বার গর্ভধারণ করেন; প্রতিবারই যমজ সন্তান জন্ম দেন—একটি ছেলে একটি মেয়ে।’(নবুওয়াতু আদম ওয়া রিসালাতুহু: পৃ.১১৫; মুজাজুত-তারিখিল ইসলামি: ২ / ১৩) 

আদম আ.-এর সন্তানদের বিয়ে

যেহেতু তখন পৃথিবীতে আদমসন্তান ছাড়া কোনো মানুষ ছিল না, তাই বংশবৃদ্ধির জন্য আল্লাহর নির্দেশে আদম আলাইহিস সালাম নিজের ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে দিতেন। প্রতিবারই এক ছেলে ও এক মেয়ে জন্ম নিত। নিয়ম ছিল, একবারের ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে অন্যবারের মেয়ে ও ছেলেকে বিয়ে দেওয়া হতো। নিয়ম অনুযায়ী হাবিল-কাবিলের বিয়ের বিষয়ও সামনে আসে। কাবিল বড় ছিলেন এবং তার যমজ বোনটি হাবিলের যমজ বোনের চেয়ে বেশি সুন্দর ছিলেন। এ কারণে কাবিল তার যমজ বোনকে হাবিলের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। (ইবনে কাসির, কাসাসুল কোরআন) 

কোরবানি

এই সমস্যার সমাধান হিসেবে আদম  আলাইহিস সালাম সিদ্ধান্ত দিলেন—তারা দুজনে আল্লাহর দরবারে কোরবানি পেশ করবেন। যার কোরবানি কবুল হবে, তিনি নিজের ইচ্ছা পূরণের অধিকার পাবেন। 

সে যুগে কোরবানি ও মানত কবুল হয়েছে কি না—তা বোঝা যেত- নিয়ম অনুযায়ী, মানত ও কোরবানির বস্তু কোনো উঁচু স্থানে রেখে আসতে হতো। সেটি আল্লাহ দরবারে কবুল হলে আসমান থেকে আগুন এসে বস্তুটি পুড়িয়ে দিত। 

হাবিল পশু পালন এবং কাবিল কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। নিয়মান অনুযায়ী হাবিল নিজের পশুর পাল থেকে একটি হৃষ্টপুষ্ট দুম্বা আল্লাহর নামে কোরবানি দেন। আর কাবিল নিজের শস্যভাণ্ডার থেকে কিছু শস্য কোরবানির জন্য পেশ করেন। 

সেকালের কোরবানির নিয়ম অনুসারে অদৃশ্য থেকে আগুন এসে হাবিলের কোরবানির বস্তু পুড়িয়ে ফেলল। আর কাবিলের কোরবানির বস্তু যেমন রাখা হয়েছিল, তেমনই রয়ে গেল। 

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তাদের যথাযথভাবে শোনাও। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্য জনের কোরবানি কবুল হলো না।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত, ২৭) 

কাবিলের প্রতিক্রিয়া

কোরবানি কবুল না হওয়ায় কাবিল অপমানিত হলেন এবং ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘(একজন) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব।’ বিপরীতে হাবিল শান্ত ভাষায় তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন এবং খুনের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করলেন। হাবিল বললেন, ‘আল্লাহ তো সংযমীদের কোরবানিই কবুল করে থাকেন। আমাকে খুন করতে তুমি হাত বাড়ালেও তোমাকে খুন করতে আমি হাত বাড়াব না। নিশ্চয়ই আমি সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহকে ভয় করি। তুমি আমার ও তোমার পাপের ভার বহন করো এবং জাহান্নামি হও—এই তো আমি চাই; এটিই অনাচারীদের কর্মফল।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত, ২৭-২৯) 

হাবলিকে হত্যা

এরপর কাবিল আর ধৈর্য ধরতে পারলেন না। হাবিলের উপদেশ ও সতর্কবার্তা কাবিলের মনে তীরের মতো বিঁধতে লাগল। তিনি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন এবং ছোট ভাই হাবিলকে নির্মমভাবে হত্যা করলেন। 

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এরপর তার মন তাকে ভাইকে খুন করতে প্ররোচনা দিল এবং সে (কাবিল) তাকে (হাবিলকে) হত্যা করল। ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত, ৩০) 

পৃথিবীতে প্রথম মৃতকে দাফন 

ভাইকে খুন করে কাবিল অস্থির হয়ে পড়লেন। এখন এই লাশ নিয়ে তিনি কী করবেন, বুঝতে পারছিলেন না। তখনো পৃথিবীর কোনো আদমসন্তান মারা যাননি। হজরত আদম আলাইহিস সালাম লাশ সম্পর্কে কোনো বিধানের কথাও বলেননি। সেই দিশেহারা অবস্থায় কাবিল খেয়াল করলেন, একটি কাক মাটিতে গর্ত করে আরেকটি মৃত কাককে মাটিচাপা দিচ্ছে। কাবিল তা দেখে নিজের অযোগ্যতার জন্য আফসোস করলেন এবং মনে মনে বললেন, আমি এই তুচ্ছ প্রাণীর চেয়েও নিকৃষ্ট হলাম। নিজের এই অপরাধ গোপন করার যোগ্যতাও আমার নেই। এরপর সেভাবেই ভাইয়ের মৃতদেহ মাটিচাপা দিলেন। (তাবারি, কাসাসুল কোরআন, তাফসিরে জালালাইন, ২য় খণ্ড, ১১১) 

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এরপর আল্লাহ এক কাক পাঠালেন, যে তার ভাইয়ের মৃতদেহ কীভাবে গোপন করা যায়, তা দেখাবার জন্য মাটি খুঁড়তে লাগল। সে বলল, হায়! আমি কি এই কাকটির মতোও হতে পারলাম না, যাতে আমার ভাইয়ের মৃতদেহ গোপন করতে পারি! এরপর সে লজ্জিত হলো।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত, ৩১)