মহামারি থেকে সুরক্ষায় ১০ আমল
দেশে করোনা মহামারি বা কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে। আক্রান্তের ও মৃতের সংখ্যাও আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। তাই সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সর্বাত্মক সতর্ক থাকার আহ্বান জারি করা হয়েছে।
নিরন্তর সত্য যে, নানা সময়ে বিভিন্ন রোগব্যাধি ও ভাইরাস জানান দেয়, আমরা যত উন্নতিই করি— মহান আল্লাহর করুণা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। পাশাপাশি জেনে রাখা জরুরি যে, মহামারি দেখা দিলে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী সবাই আক্রান্ত হতে পারে।
বিজ্ঞাপন
মর্যাদা বৃদ্ধি ও পাপ মার্জনা
তবে ফলাফলের বিচারে সবাই সমান নয়। কোনো ঈমানদার মহামারিতে আক্রান্ত হলে আল্লাহর প্রতি তার আস্থা, বিশ্বাস ও প্রত্যাশাগুলো একজন অবিশ্বাসীর চেয়ে অবশ্যই ভিন্ন হয়— যা তার মর্যাদা বৃদ্ধি ও পাপ মার্জনা করে। দৃঢ় বিশ্বাস ও আল্লাহর প্রতি আস্থা বিপদ-আপদকে মুমিনের জন্য রহমতে পরিণত করে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘মহামারি আমার উম্মতের জন্য শাহাদাত ও রহমতস্বরূপ। আর অবিশ্বাসীদের জন্য শাস্তি।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২০৭৬৭)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুমিনের বিষয় কী বিস্ময়কর! তার সবকিছু কল্যাণকর, যা মুমিন ছাড়া আর কারও জন্য প্রযোজ্য নয়। সে যদি কোনো আনন্দের বিষয় লাভ করে এবং কৃতজ্ঞতা আদায় করে, এটা তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি কোনো কষ্টকর বিষয়ে সে আক্রান্ত হয়ে ধৈর্যধারণ করে, এটাও তার জন্য কল্যাণকর।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৯৯৯)
বিপদে আক্রান্ত হওয়ার আগে
উসমান ইবনে আফফান (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, “যে ব্যক্তি ‘বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মা’আসমিহি শাইয়ুন ফিল আরদি ওলা ফিসসামা-ই ওয়া হুয়াস-সামিউল আলিম’
অর্থ : আল্লাহর নামে, যার নামের বরকতে আসমান ও জমিনে কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারে না, তিনি সব শোনেন এবং সব জানেন।
দোয়াটি সন্ধ্যায় তিনবার পাঠ করবে, সকাল পর্যন্ত আকস্মিক বিপদ তাকে আক্রান্ত করবে না। একইভাবে যে ব্যক্তি সকালে তিনবার পড়বে, সন্ধ্যা পর্যন্ত আকস্মিক কোনো বিপদ তাকে আক্রান্ত করবে না। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৮৬)
দোয়া ইউনুস পাঠ বেশি করে
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অন্ধকারের মধ্যে তিনি বললেন, তুমি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, তুমি নির্দোষ, আমি গুনাহগার। অতঃপর আমি তার আহ্বানে সাড়া দিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। এভাবেই আমি বিশ্বাসীদের মুক্তি দিয়ে থাকি। (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৮৭-৮৮)
প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা ও হাদিস বিশারদ ইবনে কাসির (রহ.) আয়াতের ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘মুমিন বান্দা বিপদগ্রস্ত হয়ে যখন আমার দিকে প্রত্যাবর্তন করে এবং এই দোয়ার মাধ্যমে আমাকে ডাকে, তখন আমি তাদের মুক্তি দিই।’
তিনি রাসুল (সা.)-এর এ হাদিসটি উল্লেখ করেন—
যেখানে তিনি বলেছেন, ‘মাছওয়ালা মাছের পেটে যে দোয়া করেছিল; (লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালেমিন— এটির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি আল্লাহকে ডাকলে তিনি অবশ্যই সাড়া দেবেন।
(তিরমিজি, হাদিস : ৩৫০৫)
বিপদ-আপদের কষ্ট থেকে আশ্রয় কামনা
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) বিপদ, দুর্ভাগ্য, অনিষ্ট ও শত্রুর বিদ্বেষ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৯৮৭)
অন্য বর্ণনায় রাসুল (সা.) উম্মতকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোমরা বিপদ, কষ্ট, দুর্ভাগ্য, অনিষ্ট ও শত্রুর বিদ্বেষ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও। (বুখারি, হাদিস : ৬২৪২)
ঘর থেকে বের হওয়ার দোয়া পড়া
আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.) ইরশাদ করেন, “যখন কেউ ঘর থেকে বের হয় এবং এই দোয়া পড়ে—
উচ্চারণ : বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ লা হাওলা ওলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
অর্থ : আল্লাহর নামে, তার ওপর ভরসা করে (বের হলাম) আল্লাহ ছাড়া কোনো ভরসা নেই; কোনো ক্ষমতা বা শক্তি নেই।”
তখন তার ব্যাপারে ঘোষণা দেওয়া হয় তুমি সঠিক পথের দিশা পেয়েছো, এটি তোমার জন্য যথেষ্ট হয়েছে; তুমি সুরক্ষা লাভ করেছো। অতঃপর শয়তান তার থেকে দূরে সরে যায়। তখন অন্য শয়তান বলতে থাকে, কেমন লাগল ওই লোকটিকে যে সঠিক পথের দিশা লাভ করেছে, সুরক্ষা পেয়েছে নাকি? (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৯৫)
সকাল-সন্ধ্যা সুস্থতা কামনা
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) সকাল-সন্ধ্যা এই দোয়াগুলো কখনোই বাদ দিতেন না—
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল আফিয়াতা ফিদ দুনইয়া ওয়াল আখিরাহ। আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল আফওয়া ওয়াল আফিয়াতা ফি দিনি ওয়া দুনইয়ায়া ওয়া আহলি ওয়া মালি। আল্লাহুম্মাসতুর আওরাতি ওয়া আমিন রাওআতি। আল্লাহুম্মাহফিজনি মিন বাইনি ইয়াদাইয়া ওয়া মিন খলফি ওয়া আন ইয়ামিনি ওয়া আনন শিমালি ওয়া মিন ফাওকি ওয়া আউজু বিআজমাতিকা মিন আন উগতালা মিন তাহতি।
অর্থ : হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে দুনিয়া ও আখিরাতের সুস্থতা ও নিরাপত্তা কামনা করি। হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে ক্ষমা এবং আমার দীন, দুনিয়া, পরিবার ও সম্পদের নিরাপত্তা চাই। হে আল্লাহ, আমার দোষগুলো ঢেকে রাখুন; আর ভালো গুণগুলো রক্ষা করুন। হে আল্লাহ, আমাকে সম্মুখ-পেছন, ডান-বাম ও ওপর থেকে হেফাজত করুন। হে আল্লাহ, আমি আপনার মহত্ত্বের দোহাই দিয়ে নিচের দিকের গুপ্ত অনিষ্ট থেকে আপনার আশ্রয় কামনা করছি। (বোখারি, হাদিস : ১২০০)
বেশি পরিমাণে দোয়া করা
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যার জন্য দোয়ার দরজা খুলে যায়, রহমতের সব দরজা তার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। আর আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে প্রিয় দোয়া হলো, নিরাপত্তা ও সুস্থতার দোয়া করা।
রাসুল (সা.) আরও ইরশাদ করেন—
আপতিত ও অনাগত উভয় প্রকার মুসিবতের ক্ষেত্রে দোয়া উপকার বয়ে আনে। সুতরাং হে আল্লাহর বান্দারা, তোমরা দোয়া করতে থাকো।
তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৪৮
মহামারি আক্রান্ত এলাকা এড়িয়ে চলা
আবদুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, উমর (রা.) শামের উদ্দেশে বের হয়েছিলেন। পথিমধ্যে সরগ নামক স্থানে পৌঁছার পর তিনি জানতে পারলেন, শামে মহামারি দেখা দিয়েছে। তখন আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) তাকে বললেন যে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা যখন কোনো ভূমিতে মহামারি আক্রমণের খবর শুনবে সেখানে যাবে না। একইভাবে তোমরা যেখানে বসবাস করছো, সেখানে যদি মহামারি দেখা দেয়; সেখান থেকে পালাবে না।’ (বোখারি, হাদিস : ৬৫৭২ মুসলিম, হাদিস : ২২১৯)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘অসুস্থকে সুস্থ এর সঙ্গে রাখা হবে না। (বোখারি, হাদিস : ৫৭৭১)
পরোপকার ও জনকল্যাণমূলক কাজ করা
আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘জনকল্যাণমূলক কাজ খারাপ মৃত্যু, বিপদ-আপদ ও দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। আর দুনিয়ার কল্যাণকামী আখিরাতে কল্যাণপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস : ৪২৯)
ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, অসুস্থতার অন্যতম চিকিৎসা হলো জনকল্যাণমূলক কাজ, জিকির, দোয়া, তাওবা ও আল্লাহর দরবারে ক্রন্দন। রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের ক্ষেত্রে এগুলোর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এমনকি এগুলো বস্তুগত ওষুধের চেয়েও অধিক ক্রিয়াশীল। তবে এগুলো ব্যক্তির আত্মিক অবস্থা ও আকিদা-বিশ্বাসের ওপর অনেকটা নির্ভর করে। (জাদুল মাআদ : ৪/১৩২)
কিয়ামুল লাইল বা রাত্রিকালীন নামাজ
বিলাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা কিয়ামুল লাইল বা রাত্রিকালীন নামাজের প্রতি যত্নবান হও। কেননা, এটি তোমাদের পূর্ববর্তী পুণ্যবানদের অভ্যাস। কিয়ামুল লাইলের দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়। কৃত অপরাধের কাফফারা হয়। শরীর থেকে রোগবালাই দূর হয়। (তিরমিজি, হাদিস : ৪৫৪৯)
হাঁড়ি-পাতিল ও পানপাত্র ঢেকে রাখা
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা হাঁড়ি-পাতিল ও পানপাত্রগুলো ঢেকে রাখো। কেননা, বছরের কোনো এক রাতে মহামারি নেমে আসে। অতঃপর ঢাকনাবিহীন হাঁড়ি-পাতিল ও খোলা পানপাত্রে তা প্রবেশ করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২০১২)
ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন—
হাদিসে বর্ণিত এই বিষয়টি চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন পর্যন্ত উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়নি।
(জাদুল মাআদ : ৪/২২১)
মোট কথা, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত আল্লাহর ওপর ভরসা করা। তার অনুগ্রহ কামনা করা ও তার কাছেই সবকিছু সমর্পণ করা। কেননা, সবকিছুই তার ক্ষমতার অধীন এবং তার নির্দেশের অনুগত। একইভাবে মুসলমানদের কর্তব্য হলো বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ করা ও সওয়াবের প্রত্যাশা করা। কেননা, আল্লাহতায়ালা ধৈর্যধারণকারীকে বিপুল সওয়াব ও প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘ধৈর্যশীলরা অগণিত পুরস্কার লাভ করেন।’ (সুরা জুমার, আয়াত : ১০)