ছবি : সংগৃহীত

মহামারির মতো বিপদ-আপদ রাসুল (সা.)-এর যুগেও ছিল। সাহাবায়ে কেরামের সময়কালেও বিভিন্ন মহামারির উদ্ভব ঘটেছে। আর তারাও অত্যন্ত চমৎকারভাবে সেগুলো মুকাবিলার ব্যবস্থা নিয়েছেন। মানুষের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.)-এর যুগে মহামারি সংক্রমণটা একটু বেশি হয়েছে। সেগুলো মুকাবিলায় তিনি নানা নির্দেশনা দিয়েছেন। যেগুলোর অনুসরণ বর্তমানকালের মহামারিতে সুরক্ষায় সহায়ক হবে।

‘তাউন আমওয়াস’ মহামারি
ফিলিস্তিনের আল-কুদস ও রামলা। এর মধ্যভাগে অবস্থিত আমওয়াস বা ইমওয়াস অঞ্চল। সেখানে প্রথম প্লেগ রোগ প্রকাশ পায়। অতঃপর তা সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামের ইতিহাসে তা ‘তাউন আমওয়াস’ নামে পরিচিত।

আমওয়াস অঞ্চল এখন ইসরায়েলের দখলে। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। পরে ওই স্থানে কানাডাভিত্তিক ইহুদি তহবিলের অর্থায়নে একটি পার্ক তৈরি করে। বর্তমানে সেটা ‘কানাডা পার্ক’ নামে পরিচিত।

১৭ হিজরি ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ। উমর (রা.) দ্বিতীয়বারের মতো সিরিয়া পরিদর্শনে বের হন। তিনি সিরিয়ায় পৌঁছার পর শুনতে পান— সেখানে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তা ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে।

উমর (রা.)-এর পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত
আবদুল্লাহ বিন আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে, উমর বিন খাত্তাব (রা.) সিরিয়ার তাবুক গ্রামের ‘সারগ’ নামক এলাকার কাছে পৌঁছেন। তিনি সেখানে এলে সেনাপতি আবু উবাদাহ ও অন্য নেতাদের সঙ্গে দেখা হয়। উমর (রা.)-কে তারা অবহিত করেন যে, সিরিয়ায় মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের কথা শোনে উমর (রা.) আমাকে বললেন, ‘ইসলামের প্রথম পর্যায়ের মুহাজিরদের ডাকো।’ তাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। কেউ বললেন, আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশে বের হয়েছেন। তা না করে ফিরে যাওয়া আমরা সমীচীন মনে করছি না। আবার অনেকে বললেন, আপনার সঙ্গে অনেক মানুষ ও রাসুল (সা.)-এর মহান সাহাবিরা আছেন। এমতাবস্থায় তাদের নিয়ে আপনি মহামারি আক্রান্ত এলাকায় যাবেন না।

সবার কথা শুনে উমর (রা.) বললেন, ‘তোমরা চলে যাও।’ অতঃপর উমর (রা.) আমাকে বললেন, ‘আনসারদের আমার কাছে ডেকে আনো।’ তাদের ডেকে পরামর্শ করলেন। তাদের মধ্যেও মুহাজিরদের মতো মতবিরোধ দেখা দিল। তিনি বললেন, ‘তোমরা চলে যাও।’ অতঃপর আমাকে বলেন, ‘এখানে কুরাইশ বংশের প্রবীণ মুহাজির সাহাবিদের ডাকো।’ আমি তাদের ডেকে আনি। তাদের মধ্যে দুজনও মতবিরোধ করেনি। সবাই অভিন্ন মত উপস্থাপন করে বললেন, আমরা মনে করছি, আপনি সব মানুষকে নিয়ে ফিরে যাবেন। মানুষকে এই মহামারীতে নেবেন না।’

অতঃপর উমর (রা.) সবাইকে সামনে নিয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘আমি চলে যাব। তোমরাও চলে যাও।’ [তখন সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.)] এ কথা শুনে আবু উবায়দা (রা.) বললেন, ‘আপনি আল্লাহর তাকদির থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন?’ উমর (রা.) বলেন, ‘আহ, হে আবু উবায়দা, এমন কথা তুমি ছাড়া যদি অন্য কেউ বলত!’ মূলত উমর (রা.) তার মতভিন্নতাকে অপছন্দ করেছেন।

এক তাকদির থেকে অন্য তাকদিরে
পরে উমর (রা.) আবু উবায়দার প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর এক তাকদির থেকে অন্য তাকদিরের দিকে পালিয়ে যাচ্ছি। যেমন মনে করো, তোমার অনেক উট আছে। তা নিয়ে তুমি এক উপত্যকায় এসেছ। উপত্যকার দুটি প্রান্ত আছে। এক প্রান্ত উর্বর। আরেক প্রান্ত শুষ্ক। তুমি উর্বর প্রান্তে উট চরালে কি আল্লাহর তাকদিরের ওপর নির্ভর করবে না? এবং শুষ্ক প্রান্তে  চরালেও কি আল্লাহর তাকদিরের ওপর নির্ভর করবে না?’

কিছুক্ষণ পর আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) এলেন। কোনো এক প্রয়োজনে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, এ বিষয় সম্পর্কে আমার জ্ঞান আছে। আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে শুনেছি, ‘তোমরা কোনো অঞ্চলে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা শুনলে তাতে প্রবেশ করবে না। তবে সেখানে থাকাবস্থায় প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়লে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না।’ এ কথা শুনে উমর (রা.) আলহামদুলিল্লাহ বললেন। অতঃপর সবাই ফিরে গেলেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭২৯)

মহামারি যখন চরম আকার ধারণ করে
উমর (রা.) মহামারি চরম আকার ধারণের খবর পান। তখন তিনি চাইলেন সেনাপতি আবু উবায়দা (রা.)-কে ফিরিয়ে আনতে। তাই উমর (রা.) একটি চিঠি লিখলেন, ‘তোমার ওপর শান্তি বর্ষণ হোক। তোমার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ সম্পর্কে সরাসরি তোমাকে বলতে চাই। তাই তোমাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বলছি, আমার পত্র পড়ে আমার উদ্দেশে বের হওয়ার আগে পত্রটি তোমার হাতছাড়া করবে না। রাতে পত্র পৌঁছালে সকাল হওয়ার আগেই যাত্রা শুরু করবে। আর দিনের বেলায় পৌঁছালে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই যাত্রা শুরু করবে।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৭/৪৪)

আবু উবায়দা (রা.) পত্র পড়ে উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমিরুল মুমিনিনকে ক্ষমা করুন।’ অতঃপর উমর (রা.)-এর উদ্দেশে একটি পত্র লেখেন, ‘হে আমিরুল মুমিনিন, আমি আপনার প্রয়োজনের বিষয় বুঝেছি। আমি এখন মুসলিম সেনাবাহিনীতে অবস্থান করছি। তাদের ছেড়ে যেতে চাই না। আল্লাহতায়ালা আমিসহ সবার ব্যাপারে ফায়সালা করবেন। অতএব হে আমিরুল মুমিনিন, আপনার সিদ্ধান্ত থেকে আমাকে মুক্ত করুন। আমার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে আমাকে থাকতে দিন।’

আবু উবায়দা (রা.)-এর পত্র পড়ে উমর (রা.) কাঁদতে শুরু করেন। আশপাশের লোকজন ও সঙ্গীরা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আমিরুল মুমিনিন, আবু উবায়দা কি শহীদ হয়েছেন? উমর (রা.) বলেন, ‘না, তিনি এখনো শহীদ হননি। কিন্তু ...।’ অর্থাৎ শিগগির তিনি শহীদ হবেন।  এর কিছুদিন পরই আবু উবায়দা (রা.) প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৭/৪৪)