প্রতীকী ছবি

নবীজি হজরত মুহাম্মদ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ কোরআন দ্বারা সম্মানিত করেছেন। কোরআন তার বড় মোজেজা তথা নবুয়তের পক্ষে দলিল। সর্বশেষ গ্রন্থ হিসেবে আল্লাহ তায়ালা নাজিলের প্রথম দিন থেকে তা সংরক্ষণ করেছেন।

ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমি অবশ্যই তা সংরক্ষণ করব।’ (সুরা হিজর, আয়াত : ০৯)

শাস্ত্রবিদদের মতে, তিনভাবে পবিত্র কোরআন সংরক্ষিত হয়েছে। এক. মুখস্থকরণ, দুই. লিপিবদ্ধকরণ, তিন. জীবনে বাস্তবায়ন। জিবরাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে কোরআন মুখস্থ করিয়ে দিতেন বা আল্লাহ সরাসরি কোরআন রাসুলুল্লাহর (সা.) অন্তরে ঢেলে দিতেন। ফলে তিনি তা আত্মস্থ করে ফেলতেন। অতঃপর আল্লাহর রাসুল (সা.) সাহাবিদের তা শেখাতেন। তারা মুখস্থ করতেন, লিখে রাখতেন এবং জীবনে তার বাস্তবায়ন করতেন কোনো প্রকার সংকোচ ছাড়াই। এভাবেই কোরআন মহানবী (সা.) ও তার সাহাবিদের জীবনের অংশে পরিণত হতো।

সাধারণভাবে সব সাহাবিই কোরআন ও তার আয়াতগুলো মুখস্থ করতেন। তার ওপর আমল করতেন। আর লিখে রাখতেন তাদের কয়েকজন মাত্র। সাহাবিদের মধ্যে যারা কোরআন লিপিবদ্ধ করতেন তাদের দুটি শ্রেণি ছিল। 

একদল যারা আল্লাহর রাসুল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। অপর দল যারা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই তা সংরক্ষণ করতেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবিরা খেজুর গাছের ছাল, পাথর, চামড়া, কাগজ ও হাড়ের ওপর কোরআন লিপিবদ্ধ করতেন। এরপর তা রাসুল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঘরে জমা করতেন। 

কোরআন সংরক্ষণে রাসুল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখস্থ করার পাশাপাশি লিপিবদ্ধ করার ওপরও জোর দেন। ওহি নাজিল হওয়ার পর তিনি বলতেন, ‘এসব আয়াতকে সেই সুরার অন্তর্ভুক্ত করো, যাতে এটা ও এটার উল্লেখ আছে।’

(ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.), মুওয়াফাকাতুল খাবারি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৪৪] রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায়ই সম্পূর্ণ কোরআন লিপিবদ্ধ হয়। (আবদুল্লাহ শাহাতা, উলুমুল কোরআন, পৃষ্ঠা : ২১-২২)

জাহেলি যুগে ও ইসলামের সূচনাকালে আরবে লিখতে পারা লোকের সংখ্যা ছিল খুবই সামান্য। ফলে শিক্ষিতজনদের বিশেষ মর্যাদা ছিল সমাজে। রাসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরব সমাজে শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ উদ্যোগ নেন। মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সর্বস্তরের মুসলমানের শিক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। তার প্রচেষ্টায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা দুই-তিনজন থেকে বেড়ে পঞ্চাশে উপনীত হয়। এদের ভেতর প্রায় ৪০ জনই কখনো না কখনো ওহি লিপিবদ্ধ করার কাজ করেছেন। আবার কেউ কেউ ওহি না লিখলেও রাষ্ট্রীয় অন্যান্য কাজে অংশগ্রহণ করতেন। 

মক্কায় সর্বপ্রথম ওহি লিপিবদ্ধ করেন আবদুল্লাহ বিন আবি সারাহ (রা.)। আর মদিনায় সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে ওহি লিপিবদ্ধ করেন উবাই বিন কাব (রা.)। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি ওহি লিপিবদ্ধ করেন জায়েদ বিন সাবিত (রা.)। কোরআন সংরক্ষণ ও মলাটবদ্ধ করার পেছনে এই মহান সাহাবির অবদান অপরিসীম। ইমাম বোখারি (রহ.) জায়েদ বিন সাবিত (রা.)-কে  ‘কাতিবুন নাবি’ বা নবীর লেখক হিসেবে বিশেষায়িত করেছেন। (হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.), ফাতহুল বারি, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা-২২)

ওহি লেখক হিসেবে সাহাবিদের ভেতর খ্যাতিমান ছিলেন জায়েদ বিন সাবিত (রা.), আলী ইবনে আবি তালেব (রা.), উবাই বিন কাব, উসমান বিন আফফান (রা.), জোবায়ের ইবনুল আওয়াম প্রমুখ। 

এ ছাড়া আবদুল্লাহ ইবনে আরকাম, মুগিরা বনি শোবা, মুআইকিব বিন আবি ফাতিমা, হানজালা বিন রাবি, শুরাহবিল ইবনে হাসনাহ, আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) রাসুল (সা.)-এর লেখক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। 

কতজন সাহাবি নিয়মিত ওহি লিপিবদ্ধ করতেন তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতভিন্নতা রয়েছে। কেউ বলেছেন ১৩ জন। কারো দাবি, তাঁদের সংখ্যা বিশের বেশি ছিল। 

আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে তাঁদের সংখ্যা ২৩ জন লিখেছেন। তিনি তাদের নাম ও জীবনী লিপিবদ্ধ করেছেন। তারা হলেন—আবু বকর, ওমর, উসমান, আলী, আব্বান বিন সাঈদ, উবাই বিন কাব, জায়েদ বিন সাবিত, মুআজ বিন জাবাল, আরকাম বিন আবিল আরকাম, সাবিত বিন কায়েস, হানজালা বিন রাবি, খালিদ বিন সাঈদ, খালিদ বিন ওয়ালিদ, জোবায়ের ইবনুল আওয়াম, আবদুল্লাহ বিন আবি সারাহ, আমের বিন ফাহিরা, আবদুল্লাহ বিন আরকাম, আবদুল্লাহ বিন জায়েদ, আলা বিন হাদরামি, মুহাম্মদ বিন মাসলামা, মুয়াবিয়া বিন আবি সুফিয়ান, মুগিরা বিন শোবা (রা.)। (খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা : ৩২১-৫৬)

ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) এসব সাহাবির মর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই তারা ছিলেন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত। আল্লাহ তাদের তাঁ কালাম লিপিবদ্ধ করার জন্য মনোনীত করেছেন এবং তার নবী (সা.) তাঁদের প্রতি আস্থা রেখেছেন, যা তাদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের শক্তিশালী প্রমাণ।’ (হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.), ফাতহুল বারি, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ২১)।

এনটি