সূরা কাউসারে মহানবীকে যে সান্ত্বনা দিয়েছেন আল্লাহ
সূরা কাউসার, পবিত্র কোরআনের সব থেকে ছোট সূরা। এর আয়াত সংখ্যা তিন। এটি মাক্কী সূরার অন্তর্ভুক্ত।
শানে নুযুল
বিজ্ঞাপন
মুহাম্মদ ইবনে আলী, ইবনে হোসাইন থেকে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তির ছেলে মারা যেত, তৎকালীন আরবে তাকে اَبۡتَرُ (নির্বংশ) বলা হতো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছেলে কাসেম বা ইবরাহিম শৈশবেই মারা যাওয়ার পর মক্কার কাফেরেরা আল্লাহর রাসূলকে নির্বংশ বলে দোষারোপ করতে লাগলো।
তাদের মধ্যে কাফির আস ইবনে ওয়ায়েলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার সামনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনও আলোচনা হলে সে বলতো, আরেহ, তার কথা বাদ দাও। সে তো কোনও চিন্তারই বিষয় নয়। কারণ, সে নির্বংশ। তার মৃত্যুর পর তার নাম উচ্চারণের মতো আর কেউ থাকবে না। এর প্রেক্ষিতে সূরা কাউসার নাজিল করেন আল্লাহ তায়ালা। -(ইবনে কাসির, মাযহারী)
কোনও কোনও রেওয়ায়েতে আছে, ইহুদী কাব ইবনে আশরাফ একবার মক্কায় এলো, তখন মক্কার কাফেরেরা তার কাছে গিয়ে বললো- আমরা হাজিদের সেবা করি, বায়তুল্লাহ হেফাজত করি, মানুষকে পানি পান করাই, এরপরও মুহাম্মদ নিজেকে সর্বোত্তম ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করে।
একথা শুনে কাব বললো- আপনারাই তার থেকে উত্তম। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা সূরা কাউসার নাজিল করেন। -(মাযহারী)
সূরা কাউসার নিয়ে মূল আলোচনা
মোটকথা, ছেলে সন্তান না থাকার কারণে এবং অন্যান্য কারণে মক্কার কাফেরেরা আল্লাহর রাসূলকে দোষারোপ করতো, এই সূরায় তাদের সেই দোষারোপের জবাব দেওয়া হয়েছে।
বলা হয়েছে, শুধু ছেলে না থাকার কারণে যারা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দোষারোপ করতো প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণা নেই। কারণ, নবীজির বংশধর কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, যদিও তা মেয়ের পক্ষ থেকে হোক না কেন।
হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আধ্যাত্মিক সন্তান অর্থাৎ, উম্মতের সংখ্যা পূর্ববর্তী সব নবীর উম্মতের থেকেও বেশি হবে। এছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আল্লাহর কাছে অনেক প্রিয় ও সম্মানিত তাও এর তৃতীয় আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে।
হাউজে কাউসারের সুসংবাদ
হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, একদিন মসজিদে উপস্থিত হলেন আল্লাহর রাসূল। হঠাৎ তার মাঝে এক ধরনের ঘুম বা অবচেতন অবস্থা দেখা গেল। তারপর তিনি হাসি মুখে মাথা উঠালেন। তখন আমরা জিগেস করলাম, যে আল্লাহর রাসূল! আপনার হাসির কারণ কী?
তিনি বললেন, এই মুহুর্তে আমার উপর একটি সূরা নাজিল হয়েছে। এরপর তিনি বিসমিল্লাহসহ সূরা কাউসার পাঠ করলেন এবং বললেন, আল্লাহ তায়ালা আমাকে কাউসার নামে জান্নাতে একটি প্রবাহিত নদী দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এতে অসংখ্য কল্যাণ রয়েছে।
কিয়ামতের দিন আমার উম্মত এ থেকে পানি পান করতে যাবে। তাদের সংখ্যা আকাশের তারকারাজির থেকেও বেশি হবে। তবে অমুসলিম, কাফের ও মুরতাদদের হাউজে কাউসারের কাছ থেকে তাড়িয়ে দেবেন ফেরেশতারা। (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী)
মূলত এই সূরায় নবীজিকে নিয়ে কাফেরদের দোষারোপের জবাবে বলা হয়েছে, আল্লাহর রাসূলের বংশধর শুধু পৃথিবী নয় বরং তার আধ্যাত্মিক সন্তানদের সম্পর্ক হাশরের ময়দানেও অনুভূত হবে। সেখানে তারা সংখ্যায় অন্য সব নবীর উম্মতের থেকে বেশি হবে এবং তাদের সম্মান, আপ্যায়নও সব থেকে বেশি হবে।
কৃতজ্ঞতা হিসেবে নামাজ ও কোরবানির আদেশ
কাফেরদের মিথ্যা ধারণার বিপরীতে হাউজে কাউসারের সুসংবাদ দেওয়ার পর এই সূরার দ্বিতীয় আয়াতে নবীজিকে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দুটি বিষয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর তাহলো- নামাজ ও কোরবানি করা।
নামাজ শারীরিক ইবাদতগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ ইবাদত এবং কোরবানি আর্থিক ইবাদতগুলোর মধ্যে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য ও গুরুত্বের অধিকারী। এছাড়া আল্লাহর নামে কোরবানি করা প্রতিমা পূজারিদের রীতিনীতির বিরুদ্ধে একটি জিহাদও বটে।
নবীজির শত্রুরাই নির্বংশ
এর তৃতীয় আয়াতে নবীজিকে নির্বংশ বলা কাফেরদের জবাব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, নবীজির শত্রুরাই মূলত নির্বংশ। একটু খেয়াল করলেই বুঝা যায় বিষয়টি। একে তো নবীজির বংশধর কেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে থাকবে। এছাড়া একজন নবী যেহেতু উম্মতের পিতা এবং উম্মত তার আধ্যাত্মিক সন্তান। তার উম্মতও কেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে বিদ্যমান। সুতরাং এই আয়াতে শুধু নবীজির শত্রুদের সেই উক্তিই নস্যাৎ করা হয়নি বরং বলা হয়েছে, আপনাকে যারা নির্বংশ বলে তারাই প্রকৃতপক্ষে নির্বংশ।
একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্মৃতিকে কতটা মাহাত্ম্য ও উচ্চমর্যাদা দান করেছেন। তার যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে তার নাম দৈনিক পাঁচবার আল্লাহর নামের সঙ্গে মসজিদের মিনার থেকে উচ্চারিত হয়ে। পরকালেও তিনি সবার থেকে বড় সুপারিশকারীর মর্যাদা লাভ করেছেন।
এর বিপরীতে নবীজিকে নিয়ে বিষোদগার করা তৎকালীন আস ইবনে ওয়ায়েল, ওকবা ও কাব ইবনে আশরাফের সন্তান-সন্ততিরা কোথায় এবং তাদের পরিবার পরিজনের অস্তিত্বও নেই এখন পৃথিবীতে। এমনকি বর্তমান পৃথিবীতে তাদের কথা ও নামও উচ্চারিত হয় মাত্র নবীজির আলোচনা ও কোরআনের আয়াতের তাফসিরকে কেন্দ্র করে। এর বাইরে তাদের নাম উচ্চারণ করাও কেউ নেই এখন পৃথিবীতে।
সূরা কাউসারের আরবি উচ্চারণ :
اِنَّاۤ اَعۡطَيۡنٰكَ الۡكَوۡثَرَؕ ١ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانۡحَرۡ ؕ ٢ اِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الۡاَبۡتَرُ
সূরা কাউসারের বাংলা উচ্চারণ :
ইন্নাআ‘তাইনা-কাল কাওছার। ফাসালিল লিরাব্বিকা ওয়ানহার। ইন্না শা-নিআকা হুওয়াল আবতার।
সূরা কাউসারের অর্থ :
নিশ্চয় আমি আপনাকে আল-কাউসার দান করেছি। কাজেই তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামায আদায় কর এবং কুরবানী কর। (তোমার নাম-চিহ্ন কোন দিন মুছবে না, বরং) তোমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীরাই নির্বংশ।
(তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা, ৮৭৪-৮৭৮)