প্রতীকী ছবি

মুসা আলাইহিস সালাম। বনি ইসরাইল জাতির প্রতি প্রেরিত আল্লাহর বিশেষ নবী। মিশরের বাদশাহ ফেরাউনের প্রাসাদেই কুদরতিভাবে বেড়ে উঠেছেন। রাজপ্রাসাদের কড়া নিরাপত্তা ও কঠোর সুরক্ষায় লালিত-পালিত হয়েছেন।

তারুণ্যে পদার্পণ করলেন। শক্তিশালী যুবক— স্বভাবগতভাবে একটু রাগী। যখন রাগ করেন চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে যায়। শরীরের লমকূপ দাড়িয়ে যায়। একদিনের ঘটনা। মিসর শহরে দুইজন ব্যক্তি জগড়ায় লিপ্ত হলেন। একজন কিবতি, ফেরাউনের অনুসারী। অপরজন ইসরাইলি বংশীয়। তমুল জগড়া। মুসা (সা.) ঘটনাস্থলে এগিয়ে গেলেন বিবাদ মিটিয়ে দিতে। কিন্তু কিবতি লোকটির অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে এক পর্যায়ে নবী মুসা রাগান্বিত হয়ে তাকে চপেটাঘাত করেন। কিন্তু অবাক কাণ্ড! ঘটে গেল অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশীত একটি ঘটনা। লোকটি মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যুর সংবাদ বিদ্যুৎ গতিতে চারদিক ছড়িয়ে পড়ল। ফেরাউনের রাজ্যে তার অনুসারীকে হত্যা! এতো বড়ই আশ্চর্য ও বিস্ময়কর ঘটনা। চারদিক থমথমে পরিবেশ। শহরে মানুষের মুখে মুখে একটিই কথা। মুসার হাতে কিবতি হত্যা। বাদশাহ ফেরাউন মুসার ওপর ক্রোধান্বিত। রাগে অগ্নিশর্মা। উপদেষ্টাদের ডেকে পাঠালেন। বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করলেন। সিদ্ধান্ত হলো- মুসা এই দুঃসাহসীকতার জন্য তাকে হত্যা করা হোক। মুসার খোঁজে ফেরাউন বাহিনী বের হলো।

এদিকে মুসা (আ.)-এর একজন হিতৈষী তাকে সুপরামর্শ দিলেন। বললেন, মিসর ছেড়ে চলে যেতে। মাদায়িন নামে একটি শহর আছে তার সেখানে হিজরত করতে। সেখানে একজন সৎ ব্যক্তি আছেন। তাছাড়া দাম্ভিক ফেরাউনের নির্যাতনের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া জরুরি। স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের জন্য নিরাপদ স্থান দরকার। (আত-তারিক ইলা মাদয়ান, আলুকাডটনেট :১৭-০৪-২০১৮)

মুসা (আ.) তার মাদায়িন অভিমূখে রওনা হলেন। দীর্ঘ পথ ও পাহাড়-সাগর পেরিয়ে মাদায়িন শহর। পথ চলতে চলতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তৃষ্ণা নিবারণের জন্য একটি কূপের নিকট গেলেন। কিন্তু সেখানে প্রচণ্ড ভীড়। রাখালের দল ও অন্যরা নিজ নিজ পশুপালকে পানি পান করাচ্ছেন। ভীড়ের মাঝে মুসা (আ.) দেখলেন দুইজন রমণী একপাশে দাড়িয়ে আছেন। অপেক্ষা করছে পুরুষের ভীড় কমে যাওয়ার। তাদের পশুদের পানি পান করানোর জন্য এসেছে।

মুসা (আ.) তাদের অবস্থা জানতে চাইলেন। রমনীদ্বয়ের উত্তর ছিল এ রকম– ‘আমরা পুরুষের ভীড়ে পানি পান করাতে সংকোচবোধ করছি। আমরা অপেক্ষা করছি— রাখালদল চলে গেলে পানি পান করাব। তাছাড়া আমাদের পিতা একজন অতিশয় বৃদ্ধ। তিনি এ কাজ করতে অক্ষম। তাই আমরা বাধ্য হয়ে এখানটায় এসেছি।’

তাদের কথা শুনে মুসা (আ.)-এর হৃদয় বিগলিত হয়ে গেল। কূপ থেকে পানি উত্তলোন করে তিনি তাদের পশুদের পানি করাল। রমণীদ্বয় খুশি মনে বাড়ির পথ ধরল।

মুসা (আ.) দীর্ঘ পথ সফর করে এসেছেন। দীর্ঘ পথে সূর্যতাপ তাকে তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত বানিয়ে দিয়েছে। পথের পাশেই ছায়াদার বৃক্ষের নিচে বসলেন। একটু জিরিয়ে নিলেন। অতঃপর মহান আল্লাহর নিকট দোআ করলেন— তিনি যেন উত্তম মেহমানদারির ব্যবস্থা করেন। পানাহারের ব্যবস্থা করেন।

ওদিকে বৃদ্ধ পিতার কন্যাদ্বয় বাড়ি ফিরেছেন। অন্যান্য দিনের তুলনায় আগে বাড়ি ফেরায় পিতা খানিকটা বিষ্মিত হলেন। কারণ জিজ্ঞাসা করলে পিতার নিকট সব ঘটনা খুলে বললেন। বৃদ্ধ ঘটনা শ্রবণ করে দ্রুত এক মেয়েকে পাঠালেন— তাকে বাড়িতে নিয়ে আসতে। অপরিচিত লোকটিকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। মুসা (আ.) বৃদ্ধের দাওয়াত কবুল করে তার বাড়ি আসলেন। আথিতেয়তা গ্রহণ করলেন। পানাহার শেষে বৃদ্ধ লোকটি যে প্রস্তাব দিলেন তার জন্য মুসা (আ.) মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি তার দুই কন্যা থেকে একজনকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার নিবেদন করলেন। উভয় কন্যা থেকে যাকে পছন্দ হয় তাকে নির্বাচন করার সুযোগ দেন। তবে শর্ত হলো- আট বা দশ বছর বৃদ্ধের বাড়িতেই অবস্থান করতে হবে। পাশাপাশি পশুপালের সার্বিক দেখাশুনা করবে। এটাই হলো স্ত্রীর মোহরানা। মুসা (আ.) তার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। (বিনতুম মিন জাওজাতি মুসা আ.; ফতওয়া ইসলামডটনেট : ১৭-০৪-২০২৮)

বৃদ্ধের কন্যার সঙ্গে নবীর শুভ পরিণয়
ইবনে আশুরা তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আত-তাহরির ওয়াত-তানভির’- এ উল্লেখ করেছেন, মুসা (আ.) বৃদ্ধের বাড়িতে আগমন করলে তার উভয় মেয়ে থেকে যে কোন একজনকে নির্বাচন করার স্বাধীনতা দেন। এ বৃদ্ধ লোকটি কি নবুওত প্রাপ্ত নাকি সেই কওমের সৎ একজন ব্যক্তি সে ব্যাপারে আলেমদের বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। তবে প্রখ্যাত তাবেয়ি হাসান বসরি (রহ.), মালেক ইবনে আনাস ও অন্যান্যদের মতে তিনি একজন নবী ছিলেন। তার নাম শুয়াইব (আ.)। আর এটাই প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ মত।

তবে আল্লামা ইবনে কাসিরসহ কয়েক আলেমের মত হলো, বৃদ্ধ লোকটি হলো- নবী শুয়াইব (আ.)-এর চাচাত ভাই বা সেই গোত্রের একজন দ্বীনদার ব্যক্তি। নবী মুসা তার ছোট কন্যাকে নির্বাচন করেন। কেননা সে তাকে পথ দেখিয়েছেন। তার কিছু আচরণ ও ব্যবহার নবীকে মুগ্ধ করেছেন। উন্নত চরিত্র, লাজুকতা, নিজের সম্ভ্রম-আবরুর প্রতি রক্ষণশীলতার কারণে মুসা (আ.) তাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সেই কন্যার নাম ছিল ‘সাফূরা’ বা সাফূরিয়া। (ইসমু বিনতিন নবী শুয়াইব ওয়া মাআ ইসমুহা, ফাতওয়া.ইসলাম.নেট : ১৭-০৪-২০১৮)

চরিত্র মাধুর্যতায় মুসা (আ)’র স্ত্রী
মুসা (আ.)-এর স্ত্রী উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। পবিত্র কোরআনুল কারীম নিজেই সেই ঘটনার সত্যায়ন করেছেন। আল্লাহ বলেন ‘তখন নারীদ্বয়ের একজন তার কাছে সলজ্জ পদে আসল। সে বলল- ‘আমার পিতা তোমাকে ডাকছে। তুমি আমাদের পশুগুলোকে পানি পান করিয়েছ। তোমাকে তোমার প্রতিদান দেওয়ার জন্য।’ (সুরা কাছাছ, আয়াত : ২৫)

যখন মুসা (আ.) তার কাছে গেলেন আর তার নিকট সব ঘটনা বিবৃত করল। সে বলল- তুমি ভয় করো না, তুমি জালিম গোষ্ঠী থেকে রেহাই পেয়েছ।’ (সুরা কাছাছ, আয়াত : ২৫)

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুসা (আ.)-এর স্ত্রীর বিভিন্ন চরিত্র মাধূর্যতা ফুটে উঠেছে। অপরিচিত ব্যক্তি নবী মুসার নিকট গমন কালে তিনি সলজ্জ পদে গিয়েছেন এবং তার চাদর বা হাতের আস্তিন দ্বারা নিজের চেহারা আবৃত করেছেন।

নবীকে রাস্তা দেখানোর সময় তার পেছন পেছন হেঁটেছেন। যাতে কোনো পরপুরুষের নিকট তার শারীরীক গঠন বা আকার আকৃতি প্রকাশ না পায়। তাছাড়া পিতার প্রতি আনুগত্য, তার অক্ষমতায় বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করা— এগুলো তার উত্তম চরিত্রের গুরত্বপূর্ণ কিছু দিক। (আল-কাওলু ফি তা’ভিলি কাওলিহি তাআলা ‘ফাজাআতহু ইহদাহুমা আলাসতিহয়া; লাইবেরি.ইসলামওয়েভ.নেট : ১৭-০৪-২০২৮)

মুসা (আ.)-এর বিয়ে থেকে যা শিক্ষণীয়
শুয়াইব (আ.)-এর কন্যার সঙ্গে মুসা (আ.)-এর শুভ পরিণয়ের ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রম। পিতা নিজে স্বেচ্ছায় কন্যাদানে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। দুই কন্যা থেকে পছন্দ মত একটিকে বাছাই করার সুযোগ দিলেন। মুসা (আ.) ছোট কন্যাকে নির্বাচন করলেন। তিনি ছোট মেয়ের মাঝে বিশেষ কিছু গুণ ও উন্নত চরিত্রের চিহ্ন দেখতে পেয়েছেন। এছাড়াও আমাদের জন্য আরো কিছু শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে।

♦ কোনো দেশ বা শহরে কেউ যদি নিজের দ্বীন-ধর্ম, ধন-সম্পদ, ও মান-মর্যাদার নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা করে, তাহলে সে হিজরত করে অন্য দেশ বা শহরে আশ্রয় নিতে পারবে।
♦ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পরোপকার ও সাহায্য-সহযোগিতা করার মানসিকতা পোষন করা।
♦ কোনো নারী বিপদগ্রস্থ হলে তাদেরও সহযোগিতা করা। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথা বলা জায়েজ হবে না।
♦ বিপদ ও সংকীর্ণতায় মহান আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং তার নিকট সাহায্য কামনা করা। মানুষের মুখাপেক্ষী না হওয়া।
♦ কাউকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পরিপূর্ণ করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেমনিভাবে মুসা (আ.) তার শশুরকে দেওয়া ওয়াদা পুঙ্খানুপুঙ্খ পালন করেছেন। দীর্ঘ দশ বছর ওনার বাড়িতে শ্রম দিয়েছেন এবং পশুপাল দেখাশুনা করেছেন।
♦ কোনো মুসলমান কাউকে আশ্রয় দিলে তার পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া। যেমনিভাবে শুয়াইব (আ.) হযরত মুসা (আ.)-কে পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়েছেন। (আল-কাওলু ফি তা’ভিলি কাওলিহি তাআলা ‘ফাজাআতহু ইহদাহুমা আলাসতিহয়া; লাইবেরি.ইসলামওয়েভ.নেট : ১৭-০৪-২০২৮)