প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করলে যে পুরস্কার পাবেন
সাধারণত শাস্তির বিনিময়ে শাস্তি দেওয়াকে প্রতিশোধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। তবে এই বিনিময় সবসময় সার্থক হয়না। কখনো বিনিময় না নেওয়াটাও সাফল্যের কারণ হয়। সমাজে বহুলস্বীকৃত একটি ধারণা হল এই প্রতিশোধ। প্রতিশোধ নেওয়ার পেছনে মানবিক চাহিদা হচ্ছে আত্মার তৃপ্তি। কোন ব্যক্তি যখন অন্য কারো দ্বারা আক্রান্ত হয়, তার মনে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি বিচরণ করে সেটি হল প্রতিশোধ। সার্বিক বিচারে প্রতিশোধ বৈধ। কিন্তু মানবিক বিচারে এটি সামান্য আলোচনার দাবি রাখে। আসুন জেনে নেই প্রতিশোধ সম্পর্কে ইসলাম আমাদের কী বলে?
কোরাআন মাজীদ প্রতিশোধকে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করেছে এবং প্রতিশোধের স্পৃহাকে নিবারণের জন্য উৎসাহিত করা করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে কঠিন সময়েও জাতির জন্য এই শিক্ষাটি দৃষ্টান্ত হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।
বিজ্ঞাপন
এ সম্পর্কে কোরাআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘মহান রবের অনুগ্রহে আপনি তাদের প্রতি কোমল হয়েছেন। আপনি যদি কঠোর হৃদয়ের অধিকারী হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছে আসত না। একই আয়াতে এরপর বলা হয়েছে: আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন। তাদের জন্য রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং তাদের সাথে পরামর্শ করুন।’ (সুরা আলে ইমরান ১৫৯)
উক্ত আয়াতে সুস্পষ্টভাবে মহান আল্লাহ তায়ালা নবীর (সা.) প্রতি মানুষের আকর্ষণের কারণ হিসেবে প্রতিশোধ পরায়ণ না হওয়াকে বর্ণনা করেছেন এবং তিনি এই গুণের অধিকারী না হলে তার পরিণাম কী হত তাও বলে দিয়েছেন। পুনরায় মহান আল্লাহ তায়ালা প্রতিশোধ ত্যাগ করে ক্ষমার পথ অবলম্বনের তাগিদ দিয়েছেন।
পৃথিবীর কঠিন কাজগুলোর একটি হল মানুষের মন জয় করা। আবার এটি সবচেয়ে সহজও বটে। সৃষ্টির আদি থেকে আজ অব্দি যত নবী রাসুলের আগমণ হয়েছে এই ধরায় তাদের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি ধৈর্য। এবং অধিকাংশ ধৈর্য ছিল প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে।
স্বীয় জাতির কাছে যখন তারা দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে হাজির হয়েছেন। তখনি অকথ্য, অগণিত পাশবিক নির্যাতন তাদেরকে থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দিনশেষে তারা সফল। এই সাফল্যের মূলমন্ত্র প্রতিশোধ থেকে বিরত থাকা এবং ধৈর্য অবলম্বন করা।
যখনি অত্যাচার আর প্রতিশোধের আলোচনা আসে, তখনি তায়েফের ময়দানে নবীজীর প্রতি কাফেরদের অত্যাচারের স্মৃতি ভেসে উঠে। এই কঠিন সময়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন এবং জিবরাইল কর্তৃক প্রতিশোধ গ্রহণের অফারকে ছুড়ে দিয়েছিলেন তা বিশ্ববাসীর জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
মহান আল্লাহ তায়ালা জিবরাঈল (আ.) মারফতে রাসুলের (সা.)- এর কাছে সংবাদ পাঠিয়েছিলেন যে, ‘নবী আপনি অনুমতি দিন। আমি পাহাড়ের মাঝে এই অত্যাচারীদের মিশিয়ে দিব। নবীজি উত্তরে বলেছিলেন: কখনো না। তারা জানে না বুঝে না’ (আর রাহীকুল মাখতুম ইসলাম হাউজ প্রকাশনী পৃষ্ঠা ২০৫, ২০৬)। এই যে প্রতিশোধ পরায়ণ না হয়ে সবর অবলম্বন, তার-ই ফল আজকের মুসলিম বিশ্ব।
জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যায়, যার তিক্ততা মনের গভীরে অন্ধকার হয়ে স্থান করে নেই। আর ওই ব্যক্তিকে প্রতিনিয়ত প্রতিশোধের প্রতি উদ্বেলিত করে তুলে। ধীরে ধীরে এই ব্যথা হ্রাস পায়।
একদিকে যদিও প্রতিশোধ মনের তৃপ্তি দেয় অন্যদিকে হৃদয়ের গভীরে ক্ষত সৃষ্টি করে দিয়ে যায়। যেটাকে আইনের ভাষায় বলে 'গিল্টি মাইন্ড'। অর্থাৎ অনুশোচনা। যা ওই ব্যক্তিকে প্রতিনিয়ত মানসিক যন্ত্রণা দেয়।
ব্যক্তিজীবন, রাজনৈতিক জীবন, শিক্ষাজীবন, চাকরি জীবন- এককথায় জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে প্রতিশোধের স্পৃহা নানাভাবে ধরা দেয়। প্রতিশোধকে যখন কেউ ক্ষমায় রূপান্তর করতে পারে, তখনই তার মনে আসে অনাবিল তৃপ্তি এবং মনে হয় তার উপর আমার একটা ঋণ রয়ে গেল। এই ঋণ সেই ঋণ নয় যা টাকার বিনিময়ে শোধ করা যায়। এই ঋণ একদিন পুরস্কাররূপে পদচুম্বন করবে এবং ওই ব্যক্তির জন্য মুক্তির মাধ্যম হয়ে স্বর্গে অভ্যর্থনা জানাবে।