আল্লাহর শুকরিয়া আদায় নিয়ে ইজতেমায় যা বলা হয়েছে
বিশ্ব ইজতেমার হেদায়েতি বয়ানে মাওলানা জিয়াউল হক বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা মুসলিম হিসেবে পৃথিবীতে জন্ম দেওয়ার কারণে সবার উচিত তার শুকরিয়া আদায়া করা। মুসলিম হিসেবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় হলো ইসলাম অনুযায়ী জীবনযাপন করা। দুনিয়ার জীবনযাপন যেন ইসলাম সম্মত হয় সে দিকে খেয়াল রাখা। তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, মৃত্যু পর্যন্ত ইসলামী বিধান অনুযায়ী জীবন-যাপন শিখে সেভাবেই জীবন-যাপন করা সবার দায়িত্ব। তাহলেই আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় হবে।
শুক্রবার (১৩ জানুয়ারি) প্রথম ইজতিমার বয়ানের মেম্বার থেকে এসব বলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
মাওলানা জিয়াউল হক আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করে বলেন, আল্লাহ তায়ালা নিজের দয়ায় আমাদের মুসলমান বানিয়েছেন। এতে আমাদের কোনো কৃতিত্ব নেই। কিছু লোক নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল আমরা মুসলমান হয়েছি। তারা কথাটি এমনভাবে প্রকাশ করল, যেন তারা মুসলমান হয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপরে অনুগ্রহ করেছে। তখন আল্লাহ তায়ালা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আপনি তাদের বলে দিন, তোমরা ইসলাম গ্রহণ করে আমার ওপরে অনুগ্রহ করনি। বরং তোমাদেরকে মুসলমান হওয়ার তাওফিক দিয়ে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপরে অনুগ্রহ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, যারা জীবনের সব ক্ষেত্রে দ্বীন মেনে চলে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাদের জন্য সফলতার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। যারা পরিপূর্ণ দ্বীন মেনে চলে, তারা দুনিয়া ও আখেরাতের কোথাও ব্যর্থ হয় না। পূর্বের যুগে কেউ ধনসম্পদের অভাবে বা ক্ষমতার অভাবে ব্যর্থ হয়নি। তারা ব্যর্থ হয়েছে দ্বীন না মানার কারণে। পূর্বের যুগে যত বিপদাপদ ও মুসিবত এসেছে, সেটাও দ্বীন না মানার কারণেই এসেছে। আর যারা সফল হয়েছে তারা দ্বীন মানার কারণেই হয়েছে।
হেদায়েতি বয়ানে তিনি বলেন, আমার ওপর কোনো বিপদ ও দুঃখ-দুর্দশা এলে, আগে নিজের দ্বীন ও ঈমানের দিকে দৃষ্টি দেব। নিশ্চয়ই এতে কোনো ত্রুটি রয়েছে। সেই ত্রুটি কাটিয়ে উঠতে পারলে বিপদ ও দুঃখ-দুর্দশা অবশ্যই চলে যাবে।
সবাইকে দ্বীন শেখার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে আমাদের দ্বীনকে ভালোভাবে শিখতে হবে। এরপরে এই দ্বীন নিজের জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে। আর অন্তরে বিশ্বাস রাখতে হবে, এই দ্বীন মানার কারণে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই আমাদেরকে সফলতা দান করবেন। কেউ মুসলমান হতে চাইলে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, এই কথার স্বীকারোক্তি মুখে দিতে হয়। সাথে সাথে এই কথার বিশ্বাস রাখতে হয় যে, এই কালিমার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে সফলতা দান করবেন।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়কালের একটি ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, একবার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা আবু তালিব নবীজিকে ডেকে পাঠালেন। আবু তালিবের কাছে আরবের বিভিন্ন গোত্রের বড় বড় নেতারা এসেছেন। তারা আবু তালিবকে বললেন, আপনার ভাতিজার কথা ও বিশ্বাসের সাথে আমাদের বিরোধ রয়েছে। আমরা তার সাথে এই বিরোধ দূর করতে চাই। দূর করা সম্ভব না হলে বিরোধ কমাতে চাই। আপনার ভাতিজাও কিছু বলুক আমরাও বলি। এভাবে বিরোধ দূর হোক।
তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু তালিবের কাছে আগত সেই নেতাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা যদি আমার একটি কথা মেনে নাও, তাহলে আরবের সবাই তোমাদেরকে নেতা হিসেবে মেনে নিবে এবং অনারবীরা তোমাদেরকে খাজনা দিয়ে তোমাদের অধীনস্থ হয়ে বসবাস করবে। তখন আবু জাহেল বলে উঠল, আরব-অনারব সবাই যদি আমাদেরকে নেতা মেনে নেই, তাহলে এরকম এক কথা কেন, ১০ কথা মানতেও রাজি আছি।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ তোমরা এই একটি কথা মেনে নাও, তাহলে গোটা পৃথিবী তোমাদের অধীনস্থ হয়ে যাবে। সবাই তোমাদেরকে নেতা মানবে। কারণ, এই কালিমার সাথে সব ধরনের সফলতার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তখন তারা বললো, এই কালিমা মানার জন্য আমরা কিছুতেই রাজি হব না।
মাওলানা জিয়াউল হক বলেন, মূল বিষয় হলো কালিমার প্রতি একিন (বিশ্বাস) অন্তরে সৃষ্টি করা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এই কালিমার দাওয়াত দিলেন, সাহাবায়ে কেরাম তা পূর্ণরূপে গ্রহণ করলেন। শুধু তাই নয়, সাহাবায়ে কেরাম তো কালিমার যে দাবি এবং চাহিদা রয়েছে, তাও নিজেদের জীবনে চর্চা করেছেন। এই কারণেই সাহাবায়ে কেরাম যখন কোনো বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন, কোনো কিছুর প্রয়োজন অনুভব করেছেন, তখন সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সাহায্য করেছেন। শুধু তাই নয়, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে সাহাবিদের বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছেন,‘আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট, তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।’
সাহাবায়ে কেরাম নিজেরা যেমন পূর্ণভাবে ইসলাম ও দ্বীন মেনেছেন, তেমনি অন্যরাও যেন মানতে পারে তার জন্য মেহনত করেছেন এবং এই দাওয়াতি কাজ করতে গিয়ে তারা বিপদের সম্মুখীন হলে আল্লাহর সাহায্য চলে এসেছে।
মিথ্যা, গিবত, খেয়ানত পরিহারের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ইসলামের হুকুম-আহকাম শুধু জানলে হবে না। মানতে হবে। মিথ্যা বলা গুনাহ, গিবত করা গুনাহ, খেয়ানত করা গুনাহ, এগুলো আমরা জানি। এই জানার নাম ইলম বা জ্ঞান। শুধু জানা যথেষ্ট নয়। আমাদেরকে মানতে হবে। গুনাহ ছেড়ে দিতে হবে। আমরা যখন কোনো হুকুম আহকাম জানবো, মানবো এবং পাশাপাশি এই বিধান মানলে আল্লাহ তায়ালা প্রতিদান দিবেন এই কথার বিশ্বাস যখন অন্তরে আনতে পারবো, তখনই আমলের সাথে যেই প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তা পূরণ করবেন।
ইসলামে বুনিয়াদী বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ইসলামের বুনিয়াদি কথা হলো প্রথমত এই কথার বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তায়ালা কারো মুখাপেক্ষী নন। সব মাখলুক তার মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তায়ালা যদি চান, দুনিয়ার বিভিন্ন আসবাব থেকে আমরা উপকৃত হব। কেবল তখনই আমরা উপকৃত হতে পারব। আল্লাহ তায়ালা না চাইলে দুনিয়ার কোনো আসবাব আমাদের বিন্দুমাত্র উপকার করার ক্ষমতা রাখে না।
দ্বিতীয়ত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেই জীবনব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন, এর মধ্যেই রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা। এই জীবনব্যবস্থা মানলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। যে মানে তাকে বিপদাপদ ও দুঃখ-দুর্দশা থেকে নিরাপদ রাখেন। তার কাছে কোনো টাকাপয়সা যদি না থাকে, থাকার জন্য ঘর না থাকে, পরিধান করার জন্য কাপড় না থাকে, তবুও যে দ্বীন ইসলাম মানে তাকে আল্লাহ তায়ালা উভয় জগতে সফলতা দান করবেন।
আর কারো কাছে দুনিয়ার অর্থবিত্ত, ক্ষমতা সব আছে, কিন্তু দ্বীন নেই, সে কিছুতেই সফলতা লাভ করতে পারবে না। না দুনিয়ায়, না আখেরাতে। কারণ, মানসম্মান ও সফলতা হলো আল্লাহ তায়ালার দান। এতে মানুষের কোনো হাত নেই।
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন, তোমরা এভাবে চল, এই কাজ কর, তাহলে সফল হবে। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী চললে বান্দা সফল। অন্যথায় সে অবশ্যই বিফল ও বিপদগামী হবে।
আমলের পদ্ধতি শেখার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বয়ানে আরও বলা হয়, আমরা কোনো আমল করার আগে সেই আমল কিভাবে করতে হয় তা শিখে নিব। আমল করার সময় ওই আমলের জন্য যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে তা অন্তরে বিদ্যমান রাখব। আর কোনো আমলই দুনিয়ার জন্য করব না। করব একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। সমস্ত আমল করব এখলাসের সাথে। যে আমল আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য করা হয়, কেবল সে আমলই গ্রহণযোগ্য। আর দুনিয়ার জন্য বা কোনো মানুষকে দেখানোর জন্য কোনো আমল করা হলে তা কিছুতেই কবুল হয় না। বরং এর জন্য আল্লাহ তায়ালা অসন্তুষ্ট হন।
আখেরাতের যে সুখ-শান্তি ও নিয়ামত রয়েছে তা চিরস্থায়ী। আর দুনিয়ার সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী। এই জন্য আমার সব আমল যেন আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করে আখেরাতের চিরস্থায়ী নেয়ামত লাভের জন্য হয়। অন্তরে দুনিয়ার কোনো লালসা যেন জায়গা করে না নেয় সেদিকে খুব খেয়াল রাখবো।
আর আমল করার সময় আমি মনে করব আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেখছেন। অন্যমনস্ক হয়ে বা আলস্য নিয়ে কোনো আমল করব না।
তিনি আরও বলেন, মনে রাখতে হবে আল্লাহর সমস্ত হুকুম-আহকাম আমাদের মনের চাহিদার বিপরীত। আল্লাহ তায়ালা একটা কাজ করতে বলেছেন, কিন্তু আমার মন সেই কাজ করতে চাচ্ছে না। তখন অবশ্যই আমি আল্লাহর হুকুমকে প্রাধান্য দিব। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, যারা আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য কষ্ট করে আমি তাদেরকে আমার পথের দিশা দেই।
উর্দু থেকে বয়ানটির অনুবাদ করেছেন আলেম সাংবাদিক মুহাম্মদুল্লাহ বিন ওয়াহিদ