টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুরু হয়েছে বিশ্ব ইজতেমা। করোনা মহামারিতে দুই বছর বন্ধ থাকার পর এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমার ৫৫তম আয়োজন। শুক্রবার বাদ ফজর ইজতেমার মূল কার্যক্রম শুরু হওয়ার একদিন আগে বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে ইজতেমা ময়দান। 

ইজতেমাকে ঘিরে দেশ-বিদেশ থেকে লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা একত্রিত হন টঙ্গীর তুরাগ তীরে। বিশ্ব ইজতেমা, তাবলিগ জামাতের মূল উদ্দেশ্য ও আনুসাঙ্গিক বিভিন্ন দিক নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজধানীর মারকাজুল লুগাতিল আরাবিয়্যার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও আরবি ভাষার শিক্ষক মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী।  


ঢাকা পোস্ট : তাবলিগ ও বিশ্ব ইজতেমার মূল উদ্দেশ্য কী?

মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী : তাবলিগ ও বিশ্ব ইজতেমা দুটির মাঝে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। তাবলিগ হল মানুষকে ইসলামের দিকে মৌলিকভাবে আহ্বানের একটি মাধ্যম, বিশ্ব ইজতেমা হলো- সেই মৌলিক মাধ্যমের নির্ধারিত একটি কাজ।

এর বাইরে বিশ্ব ইজতেমার উদ্দেশ্য হলো- তাবলিগের কাজের সঙ্গে জড়িতদের দ্বীনী চিন্তার মধ্যে এনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাবলিগের কাজের সঙ্গে জড়িত হওয়ার অনুপ্রেরণা দেওয়া। এর পাশাপাশি ইসলামী ও ঈমানী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে চেতনা ও অনুপ্রেরণা তৈরি করা। এছাড়া প্রত্যেকেই নিজের মাঝে ঈমানী যেই চেতনা লালন করে তা শাণিত শক্তিশালী করার একটি জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা।

ঢাকা পোস্ট : বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ওপর ইসলামের প্রভাব পড়ছে কতটা?

মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী :  বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ওপর যথেষ্ট দ্বীনী ও ঈমানী প্রভাব পড়ছে। এর মাধ্যমে মানুষের মাঝে ঈমানী চেতনা তৈরি হচ্ছে। নির্দিষ্ট তিনদিন বয়ান শোনা হলেও এর কথাগুলো মানুষের মনে দীর্ঘদিন রেখাপাত করে। এর প্রভাবে মানুষ দ্বীন, ইসলাম, ঈমান, ধর্মীয় অন্যান্য কাজ ও অনুশাসন মানার প্রতি উদ্বূদ্ধ হন।

এছাড়াও তাৎক্ষণিক একটি ফলাফল দেখা যায় যে, আগতদের অনেকেই তাবলিগের নির্ধারিত চিল্লা অর্থাৎ ৪০ দিন, চার মাস অথবা তিন দিনের জন্য হলেও আল্লাহর রাস্তায় বের হন।

 

ঢাকা পোস্ট : বিশ্ব ইজতেমা - মুসলিম দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের প্রভাব বাড়াতে কতটা সহায়তা করছে?

মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী : বিশ্ব ইজতেমার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে আসেন বিদেশী মেহমানরা। অনেকের জমায়েত হয়। এর মাধ্যমে বহির বিশ্বে বিশেষত মুসলিম দেশগুলোর কাছে মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিতি বাড়ছে।

একটি ভালো কাজের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষজন আসছেন, এতে করে ভালো একটি পরিচিতি ও বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো একটি অনুভূতি তৈরি হয় হচ্ছে দেশের বাইরে। তবে মুসলিম দেশ হিসেবে প্রভাবের যে বিষয়টি আছে তা খুব একটা বাড়ছে বলে মনে হয় না। 

ঢাকা পোস্ট : মাওলানা ইলিয়াস রহ. প্রায় শত বছর আগে তাবলিগের কাজ শুরু করেছিলেন, যা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী, বর্তমান সময়ে এসে এই জামাতটি কতটা প্রতিষ্ঠাতার উদ্দেশ্যের ওপর টিকে আছে বলা যায়?

মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী : এ বিষয়টি স্পষ্ট করে বলছি যে, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম ও মুসলমানদের সোনালী যুগ যতই পেরিয়েছে, দ্বীনী কার্যক্রম ও চেতনার দিক থেকে মানুষ ততটাই দূরে সরেছে। মানুষের ঈমানী চেতনা আবেগ-অনুভূতি কমেছে। ঠিক তেমনিভাবে ইলিয়াস রহ., তার সঙ্গে থাকা মানুষেরা যেই আবেগ-দরদ ভালোবাসা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন তাতে কিছুটা ভাটা পড়বে এটাই স্বাভাবিক।

তবে এরমাঝেও যারা দাওয়াতে তাবলিগের কাজ করছেন, এর সঙ্গে যুক্ত আছেন তারা কাজের জন্য যথেষ্ট আন্তরিক এবং কাজের প্রতি ইলিয়াস রহ.-এর যে আন্তরিকতা ও আবেগ তাদের মাঝেও তা রয়েছে।

ঢাকা পোস্ট : মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বিভিন্ন কথাকে ঘিরে এতোদিন একমত ও পথে চলা তাবলিগের সাথীদের মাঝে একটি বিভক্তি তৈরি হয়েছে- এই বিভক্তির কারণে তাবলিগের কাজে কতটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে?


মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী : মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বিভিন্ন কথাকে ঘিরে বিভক্তির কারণে অবশ্যই তাবলিগের কাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমি নিজেও অনেক কাছ থেকে এ বিষয়টি উপলদ্ধি করেছি। একেবারে গ্রাম পর্যায় থেকেও বিষয়টি দেখেছি। 

যেখানে আগে একসাথে থেকে মানুষেরা তালিম করতেন, দ্বীনী কথাবার্তা বলতেন, একসঙ্গে তাবলিগের জন্য বের হতেন, সেখানে একেবারে গ্রাম পর্যায়েও এখন বিভক্তি তৈরি হয়েছে। এক সময় একসাথে থাকা মানুষগুলোর মাঝে এখন ‘এই পক্ষ ওই পক্ষ’ বলে একটা শব্দ প্রচলিত হয়েছে। এটা স্পষ্ট একটা নেতিবাচক প্রভাব। এজন্য মাওলানা সাদ কান্ধলবী ও তার অনুসারীরা অবশ্যই দায়ী।

 ঢাকা পোস্ট : বিভক্তির কারণে মানুষ কি তাবলিগ থেকে দূরে সরে পড়ার কোনও আশঙ্কা করেন?

মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী : বিভক্তির কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ঠিক। তবে এর কারণে মানুষ তাবলিগের কাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে- এমন কিছু আসলে হয়নি। কিছু মানুষ তো আগেও ছিলেন এখনও আছেন যারা মানুষকে তাবলিগ থেকে দূরে সরাতে চাইতেন। তারা এখনও তাই করছেন।

তবে বিভক্তির পর আলেমদের বিভিন্ন স্পষ্ট বক্তব্যের কারণে কাজ আরও বেশি গতিশীল হয়েছে, বেগবান হয়েছে। আলেমরা আগের তুলনায় বেশি বেশি কাজের সাথে যুক্ত হয়েছেন, এতে কাজ সুচারুরূপে এগোচ্ছে। কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও মানুষ কাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়।

ঢাকা পোস্ট : এই বিভক্তির কারণে বিশ্ব ইজতেমার যে প্রাণ তা কি হারাতে পারে বা এমন কোনও সম্ভবনা কি তৈরি হতে পারে?

মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী :  বিভক্তির কারণে বিশ্ব ইজতেমার প্রাণ হারাতে পারে বা এমন কোনও সম্ভবনা তৈরি হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। বরং এর আগে কিছু মানুষ যে অনেকটা স্বার্থকেন্দ্রিক দাওয়াতের কাজ করতো, আবার কেউ কেউ ধর্মীয় বিষয়গুলো ঠিকমতো না বুঝে এতো দিন যে দাওয়াতের কাজ করতেন বা করছেন- তা স্পষ্ট হয়ে গেছে, বর্তমানে বরং দাওয়াতে তাবলিগের কাজের ক্ষেত্রে মানুষ সঠিক বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছে। 

আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন ইজতেমার মূলকার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে, এতে আলেম ও মাদরাসার ছাত্রদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এর কারণে ইজতেমায় নেতিবাচক কোনও প্রভাব পড়েনি, বরং আগের থেকে সাবলিলভাবে ইজতেমার কার্যক্রম চলছে। আশা করছি এবার তাবলিগের যে খুরুজ বা নির্ধারিত সময়ের জন্য আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়া তা আরও বাড়বে।

এবং এই বিভক্তির কারণে এতোদিন যারা কোরআন হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা ও চিন্তা নিয়ে কাজ করতেন আল্লাহর রহমতে তারা কাজ থেকে আলাদা হয়ে গেছেন। বর্তমানে আলেমদের মাধ্যমে কাজটি পরিচালিত হচ্ছে, এতে তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধায়ন হচ্ছে এটা ভালো দিক।

ঢাকা পোস্ট :  বিভক্তির কারণে সাধারণ মানুষের অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন- আমরা কোন মত অবলম্বন করবো, কোন দিকে ঝুঁকবো- মানুষের এমন প্রশ্নের প্রেক্ষিতে কী বলতে চাইবেন?

মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী : বিভক্তির কারণে সাধারণ মানুষের এমন প্রশ্ন থাকবেই। তবে আলেমরা মানুষকে বোঝানোর ক্ষেত্রে অনেক ভাল কাজ করেছেন, করছেন।

সাধারণ মানুষের জন্য আমরা বলবো, সঠিক জিনিস বোঝা ও চেনার জন্য আমরা অনেকে অনেকভাবে চেষ্টা করি, আমরা অনেককেই জিজ্ঞেস করি। ভাল ডাক্তার দেখাতে গেলে বা কোনও কিছু কেনাকাটা করতে গেলেও আমরা জিজ্ঞেস করি, যাচাই-বাছাই করি, এক্ষেত্রেও আমরা আলেমদের সঙ্গে কথা বলে জিজ্ঞেস করে দেখবো। তাহলে সঠিক পথ ও ঝামেলামুক্ত হয়ে তাবলিগের সঙ্গে যুক্ত থাকা যাবে ইনশাআল্লাহ। 

ঢাকা পোস্ট :  ঢাকা পোস্টকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ

মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী : সুন্দর ও জরুরি বিষয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করায় ঢাকা পোস্টকেও ধন্যবাদ।