পবিত্র মিরাজের অলৌকিক ঘটনা
বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে যেসব অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল মিরাজ তন্মধ্যে অন্যতম। পবিত্র কোরআনুল কারিম ও হাদিসের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত। মহানবীর ঐতিহাসিক মিরাজ আমাদের লক্ষ্য ও গন্তব্যের সন্ধান দেয়। মিরাজ আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সর্ম্পক গভীর করে তোলে।
কোরআন-হাদিস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে মিরাজ প্রমাণিত। তা অস্বীকার করা কুফরি। মহন রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআন কারিমের দু’টি সূরায় পবিত্র মিরাজের আলোচনা করেছেন। একটি হলো সুরা ইসরা অপরটি হলো সুরা নাজম। এ প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্ত্বা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন, মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছিলাম যেন আমি তাকে আমার নিদর্শনাবলী দেখাতে পারি। নিশ্চয়ই তিনি অধিক শ্রবণকারী ও দর্শনশীল’। (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ১)
বিজ্ঞাপন
আরবি মাস ‘রজবের’ ২৭ তারিখ নবুওয়ের দশম বর্ষে নবী করীম (সা.) এর ৫০ বৎসর বয়সে পবিত্র মিরাজ সংঘটিত হয়। (সূত্র : সিরাতে মোস্তফা: আশেকে এলাহি মিরাঠি, ও তারিখুল ইসলাম: মাওলানা হিফজুর রহমান সিহারভি)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘তার দৃষ্টিভ্রম হয়নি এবং তিনি সীমালঙ্গনও করেননি। নিশ্চয়ই তিনি তার পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছেন।’ (সুরা আন-নাজম, আয়াত : ১৭-১৮)
বিখ্যাত সাহাবি ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘রজবের সাতাইশ তারিখ রাতে হঠাৎ আমার কাছে জিবরাইল (আ.) একটি সাদা রঙের ‘বোরাক’ নিয়ে উপস্থিত হলেন। (বোরাক হচ্ছে সাদা রঙের এক প্রকার আরোহনের যন্ত্র, সে প্রতিটি কদম ফেলে দৃষ্টির শেষ সীমানায়) রাসুল বলেন আমি এত আরোহন করলাম, অতঃপর মসজিদে প্রবেশ করলাম এবং সেখানে দুরাকাত নামাজ আদায় করলাম। এরপর আমি মসজিদ থেকে বের হলাম। তখন জিবরাঈল (আ.) একটি শরাব এবং একটি দুধের পাত্র নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হলেন। তখন আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। জিবরাঈল (আ.) বললেন আপনি ফিতরাতকেই গ্রহণ করেছেন।’ (মুসলিম শরীফ ১ম.পৃ.৯১)
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) ঘটনার বর্ণনা এভাবে বর্ণনা করেন, একবার রাতে রাসুল (সা.) উম্মে হানী (রা.)-এর ঘরে বিশ্রাম করছিলেন। রাসুল (সা.) তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলেন । এমন সময় বিস্ময়করভাবে ঘরের ছাদ ফেটে যায় এবং ছাদপথে ফিরিশতা জিবরাঈল (আ.) অন্তকুঠরিতে অনুপ্রবেশ করেন। জিবরাঈল (আ.) এর সঙ্গে অন্য ফিরিশতারাও ছিলেন। জিবরাঈল রাসুল (সা.)-কে ঘুম থেকে জাগিয়ে হারাম শরিফে নিয়ে আসেন। রাসুল (সা.) এখানে এসে হাতিমে কাবায় ঘুমিয়ে যান। জিবরাঈল ও মিকাঈল (আ.) পুণরায় রাসুলকে জাগিয়ে দেন এবং ‘জমযম’ কূপের পাশা তাকে নিয়ে আসেন। সেখানে রাসুলের (সা.) বক্ষবিদারণ করে পবিত্র জমযম পানি দ্বারা তার বক্ষ মোবারক ধৌত করেন। এরপর একটি আরোহনের যন্ত্র বোরাক আনা হয়। রাসুল (সা.) সে যানবাহনে আরোহন করেন। রহমতে আলমের কুদরতি বাহন বোরাক বায়ূগতিতে চলছে। যাত্রাপথে রাসুল (সা.) ইয়াসরিব নগরীতে উপস্থিত হন। জিবরাঈল (আ.) রাসুলকে পরিচয় করিয়ে দেন এটা ‘ইয়াসরিব’ উপত্যকা। আপনার হিজরতের স্থান। রাসুল (সা.) সেখানে অবতরণ করে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। বোরাক চলতে থাকে দ্রুতগতিতে। ‘তুর’ পর্বতের পাদদেশে সানাই প্রান্তরে উপস্থিত হয়। জিবরাঈল রাসুলকে পরিচয় করিয়ে দেন এটা তোর পর্বত। এখানে আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.) নবীর সাথে কথা বলেছিলেন। এখানেই মুসা (আ.) নবুওয়াত লাভ করেছিলেন। রাসুল সেখানে অবতরণ করে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। এভাবে টর্নেডু গতিতে চলছে বোরাক। ক্রমেই ঈসা (আ.) এর জন্মস্থান ‘বায়তু লাহাম’ ফিলিস্তিনে উপস্থিত হন। জিবরাঈল (আ.) নবী (সা.)-কে পরিচয় করিয়ে দিলেন তার জন্মস্থান। তখন দিয়ে সেখানে দু’রাকাত নামাজ পড়েন। এভাবে বিভিন্ন পয়গাম্বরদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমুহ অতিক্রম করে করে ‘বায়তুল মোকাদ্দাসে’ পৌছেন।
বায়তুল মোকাদ্দিসে পৌঁছে পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসুলদের নিয়ে মসজিদে দুই রাকাত নামাজ পড়েন এবং তিনি নামাজের ইমামতি করেন।
বায়তুল মাকদিসে ইমামতির পর জিবরাঈল (আ.)- কে নিয়ে বোরাকের মাধ্যমে উর্ধ্বকাশে যাত্রা করলেন। মুহূর্তের মধ্যেই প্রথম আসমানের প্রবেশ দ্বারে এসে উপস্থিত হন। সেখানে প্রথম নবী আদম (আ.) এর সঙ্গে সালাম কুশল বিনিময় করেন। এভাবে সাত আসমানে অবস্থানকারী অন্যান্য নবীগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সালাম বিনিময় করেন। এসময় প্রত্যেক নবীই বিশ্বনবীকে অভ্যর্থনা জানান। সপ্তম আকাশের পর রাসুল (সা.) ‘সিদরাদুল মুনতাহা’ পর্যন্ত পৌছেন। তখন রাসুলে আকরাম (সা.) এমন উর্ধ্বে গমন করেন, এমনকি ‘লাওহে মাহফুজে’র কলম চালনার আওয়াজ শুনতে পান। তখন জিবরাঈল (আ.) বলেন, আমার যাত্রাপথ এখানেই শেষ। এতদপেক্ষা আপনার সঙ্গ দেওয়ার সাধ্য আর আমার নেই।
অতঃপর রাসুল (সা.) আল্লাহর এত কাছে চলে যান যে, আল্লাহপাক তার বন্ধুকে নিবিড় সান্নিধ্য দান করেন এবং এখানেই আল্লাহর দিদার লাভ করেন। একটি পর্দার আড়াল টেনে আল্লাহ তার আত্মরূপ দর্শন করান তার হাবিব ‘মোহাম্মদ মোস্তফা’ (সা.)–কে। সেখানে বিশ্বনবীকে মহান আল্লাহপাক আপ্যায়ন করান। সেখানেই রাসুল (সা.) মহান রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে একান্ত আলাপের সৌভাগ্য লাভ করেন। এখান থেকে ৫০ ওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে উম্মতে মোহাম্মদির জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ উপহার নিয়ে আসেন।
রজব মাসেই মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল। রজব বরকতময় একটি মাস। রজব ও শাবান মাস দুইটিকে রাসুল (সা.) রমজানের প্রস্তুতি মাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রজব মাসকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বেশি বেশি নফল আমল, নফল রোজা, নফল নামাজসহ অন্যান্য নেককর্মগুলোর প্রতি মনোনিবেশের করা বেশি দরকার। তবে মিরাজ উপলক্ষে শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত কোনো আমল নেই। অন্যান্য রাতের মতো নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকিরসহ বিভিন্ন নফল ইবাদত করতে শরিয়তে বাধা নেই।
লেখক : আলেম-সাংবাদিক ও প্রিন্সিপাল, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলভীবাজার।