বাংলাদেশের স্বাধীনতায় আলেমরা যে অবদান রেখেছেন
১৯৭১ সালে বহু ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে একটি লাল সবুজের মানচিত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাঙালি জাতি, পেয়েছে নিজস্ব পরিচয়। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করে একটি স্বাধীন মানচিত্র অর্জনের সংগ্রামে নেমেছিলেন দেশের সব শ্রেণীর মানুষ। উচ্চ শিক্ষিত থেকে শুরু করে গ্রামের দিন-মজুর, কৃষক, সবাই অংশ নিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। এক্ষেত্রে দেশের আলেম সমাজেরও রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান।
পাকিস্তানের পূর্ব অংশের মানুষের ওপর চালানো জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এদেশের আলেম সমাজ। তারা মুক্তির এই সংগ্রামকে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের মুক্তির সংগ্রাম বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
বিজ্ঞাপন
-(বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও উলামায়ে কেরাম, সৈয়দ মবনু)।
মাওলানা শাকের হোসাইন শিবলী তার আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন মাওলানা ইমদাদুল্লাহ আড়াইহাজারী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কী করবেন এ ব্যাপারে দেশবরেণ্য আলেম মাওলানা হাফেজ্জী হুজুরকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর অত্যাচার করেছে, সুতরাং তারা জালেম। জুলুম আর ইসলাম এক হতে পারে না। তুমি যদি মুসলমান হও তবে পাকিস্তানিদের পক্ষে যাও কীভাবে? এটা তো জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের প্রতিবাদ প্রতিরোধ।’
ইতিহাসের সূত্রে জানা গেছে, হাশেম-সোহরাওয়ার্দী ও কিরণ শংকরের স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি তোলারও আগে উপমহাদেশ ভাগের সময়কালে ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছিল, তখন বাংলার প্রখ্যাত আলেম মাওলানা মোহাম্মদ শামসুল হুদা পাঁচবাগী পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেন এবং বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন।
মাওলানা মুহাম্মদ শামসুল হুদা পাঁচবাগী তার প্রচারপত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি উপস্থাপন করে বলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত রাজনীতিতে বঙ্গীয় ওলামার ভূমিকা নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নাম। ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় মাওলানা ভাসানী তার ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি না দিলে দেশে ‘ফরাসী বিপ্লব’ করার হুমকি দেন।
বাংলার মুসলিমদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে শহীদ বুদ্ধিজীবী মাওলানা অলিউর রহমান রচনা করেছিলেন—‘ছয় দফা ইসলামবিরোধী নহে’, ‘শরিয়তের দৃষ্টিতে ছয় দফা’, ‘জয় বাংলা ও কয়েকটি স্লোগান’ ইত্যাদি। পরে ১৪ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর বুলেটে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে শাহাদাত বরণ করেন। (কালের কণ্ঠ)
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজবাড়ী জেলখানায় আটক বিহারীদের জয় বাংলার পক্ষে সমর্থন দেওয়ার অনুরোধ করায় প্রাণ দিতে হয়েছিল মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে। পাকিস্তানি বাহিনী রাজবাড়ী দখলের পর বিহারীরা জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে গলা কেটে হত্যা করে। তারপর তার পেটের মাঝখানে পাকিস্তানি পতাকা পুঁতে দিয়ে বলে, ‘আভি শালা জয় বাংলা বোলো’। (দৈনিক সংগ্রাম ৭/১১/২০১৫)
একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন সশস্ত্র যোদ্ধা ছাগলনাইয়ার মাওলানা মাকসুদ ভূঁইয়া, আল্লামা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী (রহ), হাতিয়ার মাওলানা মোস্তাফিজ, চট্টলার কমান্ডার মাওলানা সৈয়দ প্রমুখ।
এছাড়াও একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্টিফিকেটের অধিকারী আলেমদের তালিকায় আছেন মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, মাওলানা আবদুস সোবহান, মাওলানা দানেশ, মাওলানা আতাউর রহমান খান, মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মাওলানা ইমদাদুল্লাহ আড়াইহাজারী ও মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসউদ প্রমুখ।