প্রতীকী ছবি

মানুষ কখনোই শুধু নিজের ওপর নির্ভর করে জীবন চালাতে পারে না। সমাজে চলতে গিয়ে প্রতিনিয়তই একে অপরের সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। অন্যের আপদে বিপদে তার পাশে দাঁড়াতে হয়, নিজের প্রয়োজনেও অন্যের সহযোগিতা নিতে হয়। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। বলতে গেলে মানুষ মূলত সমাজবান্ধব প্রাণী। একঘেয়েমি, সবাইকে এড়িয়ে একলা চলা মানুষের স্বভাব বিরোধী।

এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন মিলেমিশে থাকে। তার মধ্যে ভালো কিছু নেই, যে মিলেমিশে থাকতে পারে না। যে ব্যক্তি মানুষের বেশি উপকার করে, সে-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ।’ (আল-মুজামুল আওসাত: ৫৭৮৭)।

অন্যের প্রয়োজনে এগিয়ে আসা

সমাজে চলতে গিয়ে মানুষ একে অপরের প্রতি যেসব বিষয়ে সব থেকে বেশি নির্ভরশীল হয় তার একটি বিশেষ প্রয়োজনে ধার-দেনা, ঋণ কর্জ করা। অন্যের প্রয়োজনে এগিয়ে এসে তাকে ঋণ দেওয়া. সাহায্য করার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে ইসলামে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘কে আছে যে আল্লাহকে কর্জে হাসানা উত্তম ঋণ দেবে, তাহলে তিনি তার জন্য একে বর্ধিত করে দেবেন এবং তার জন্য সম্মানজনক প্রতিদানও রয়েছে।’ -(সুরা-৫৭ হাদিদ, আয়াত: ১১)।

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, নিশ্চয়ই দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, যে ক্ষেত্রে তারা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান করে তাদের প্রতিদান বর্ধিত করা হবে এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান।’ (সুরা- হাদিদ, আয়াত: ১৮)।

অন্যের প্রয়োজনে এগিয়ে আসার বিশেষ ফজিলত বুঝাতে এক হাদিসে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়াবি সমস্যাগুলোর একটি সমাধান করে দেয়, আল্লাহ তায়ালা তার আখিরাতের সংকটগুলোর একটি মোচন করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনে সাহায্য করবে, আল্লাহ তায়ালাও তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে স্বাচ্ছন্দ্য দান করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-গুণ গোপন করবে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন করবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে।’ -(মুসলিম: ২৬৯৯)।

ঋণ পরিশোধে স্বচ্ছতা যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

কোরআন এবং হাদিসের মাধ্যমে অন্যকে সাহায্য ও বিশেষ প্রয়োজনে ঋণ দেওয়ার গুরুত্বের বিষয়টি সহজেই বুঝে আসে। তবে বর্তমান সমাজে ঋণ দেওয়ার পর অনেককেই বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। ঋণ নেওয়ার পর ঋণ গ্রহীতা লেনদেন পরিশোধে স্বচ্ছতার পরিচয় দেন না, অধিকাংশ সময় গরিমসি করেন। অনেক ক্ষেত্রে পরিশোধের ভয়ে ঋণদাতার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এতে ঋণগ্রহীতা যে ব্যাপক ক্ষতি করে তার একটি হলো ঋণদাতা পরবর্তীতে অন্য কোনও বিশেষ প্রয়োজনগ্রস্তকে সাহায্য করার আগ্রহ ও মানসিকতা হারিয়ে ফেলেন। 

অথচ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত হলো ঋণদাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং তিনি খুশি হন এমন কথা বলা। এতে তিনি পরবর্তী সহযোগিতা করতে উৎসাহ পান। হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আবি রাবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, হুনাইন যুদ্ধের সময় নবী (সা.) আমার কাছ থেকে ৩০ বা ৪০ হাজার (দিরহাম) ঋণ নিয়েছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তিনি তা পরিশোধ করেন এবং বলেন, ‘বারকাল্লাহু লাকা ফি আহলিকা ওয়া মালিকা’। (আল্লাহ তোমার পরিবারে ও সম্পদে বরকত দান করুন) ঋণের বিনিময় হলো, পরিশোধ ও কৃতজ্ঞতা। -(মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৬৪১০; নাসায়ি, হাদিস: ৪৬৮৩)

তাই এবিষয়েটির প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রত্যেক মুসলমান ও মুমিনের কর্তব্য।

সদিচ্ছা থাকলে আল্লাহ ঋণ পরিশোধ সহজ করে দেন

মানুষ হয়তো অভাব-অনটন আয়-রোজকারে সংকটের কারণে ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করে বা অনেক সময় ঋণ পরিশোধ করতে চায় না। অথচ কেউ ঋণ গ্রহণের সময় তা পরিশোধের সদিচ্ছা থাকলে আল্লাহ তায়ালা বিষয়টি সহজ করে দেন। এ বিষয়ে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে মানুষের সম্পদ পরিশোধের নিয়তে (ঋণ) নেয়, আল্লাহ তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করে দেন। আর যে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে (ঋণ) নেয়, আল্লাহ তা ধ্বংস করে দেন।’ -(বুখারি, হাদিস: ২২৫৭)

হাদিসের মাধ্যমে বুঝা যায় নিজের একান্ত সদিচ্ছা থাকলে ঋণ পরিশোধে আল্লাহ তায়ালা সাহায্য করেন। আর ব্যক্তিত্ববান মানুষেরাই এ বিষয়ে যত্নশীল হয়ে থাকে।

দরদি নবীর শাস্তির হুঁশিয়ারি

ঋণ পরিশোধে গড়িমসির বিষয়টি অত্যন্ত গর্হিত একটি কাজ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি মুহুর্তে নিজের উম্মতের প্রতি দরদি মনোভাব রাখতেন, উম্মত কষ্ট পাবে এমন কিছু তিনি কখনো ভাবেননি। এমনকি তায়েফবাসীরা যখন তাকে আঘাত করে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল, সেই মুহুর্তেও তিনি তাদের জন্য কল্যাণ কামনা করেছিলেন।

নবীজি এমন দরদী মানুষ হওয়ার পরেও ঋণ পরিশোধে গড়িমসির বিষয়টি অপছন্দ করতেন, এমন মানুষের জন্য শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে সচ্ছল ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করে, তাকে অপমান ও শাস্তি উভয়টিই দেয়া আমার জন্য হালাল।’ -(নাসায়ি: ৪৬৯০, আবু দাউদ: ৩৬২৮, মুসনাদে আহমাদ: ১৮৯৬২)

হাদিসে ঋণ অনাদায়ের আরও কিছু ভয়াবহতা

আরেক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘ধনী/সামর্থ্যবান ব্যক্তির ঋণ আদায়ে টালবাহানা করা অন্যায়।’ (সহিহ বুখারি: ২২৮৭, মুসলিম: ১৫৬৪, মুয়াত্তা মালেক: ১৩৭৯)।

একে একে আরও বেশ কয়েকটি হাদিসে রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টির ভয়াবহতার কথা বুঝিয়েছেন। বর্ণিত হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি তার হাত দিয়ে যা গ্রহণ করেছে, তা পরিশোধ না করা পর্যন্ত সে দায়ী থাকবে (তিরমিজি: ১২৬৬, আহমাদ: ১৯৫৮২)।

আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির আত্মা লটকে থাকে, যতক্ষণ না তার পক্ষ থেকে কেউ সেই ঋণের টাকা পরিশোধ করে দেয়।’ (ইবনে মাজাহ: ২৪১৩)।

কেয়ামতের কঠিন দিনে বিচারের মুখোমুখি

ঋণদাতা তুলনামূলক দুর্বল হলে ছলচাতুরী করে পৃথিবীতে ঋণ পরিশোধ না করে হয়তোবা অনেকেই পার পেয়ে যেতে পারেন। তবে পৃথিবীর এই জীবনের পরও আরও এক অনন্ত জীবন আছে, যেখান থেকে ফেরার উপায় নেই এবং যে জীবনে এই জীবনের কর্মফলই ভোগ করতে হবে। সেখানে যেসব অন্যায়ের জন্য মানুষকে পস্তাতে হবে, বিচারের মুখোমুখি হতে হবে, তার একটি ঋণ পরিশোধ না করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি একটি দিনার অথবা দিরহাম ঋণ রেখে মারা যাবে, কেয়ামতের দিন তাকে তার নেকি থেকে সেই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কারণ সেখানে কোনো দিনার ও দিরহাম নেই।’ (ইবনে মাজাহ: ২৪১৪, আহমদ: ৫৫১৯)।

শহিদের ঋণও মাফ হবে না

ইসলামে শহিদদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এবং শহিদের সব পাপ মাফ করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেক মুমিনের জন্য শাহাদাতের মৃত্যুর কামনা থাকা উচিত। এমন সব মর্যাদার পরও শহিদের ঋণ মাফ করা হবে না। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঋণ পরিশোধের পাপ ছাড়া শহিদের সব পাপই মাফ দেয়া হবে।’ (মুসলিম: ২৯১২)।

কোরআনে  অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ না করার আহ্বান

এছাড়া অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করলে শাস্তি কঠোর শাস্তির কথা তো বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছেই। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মুমিনগণ!তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।...(সুরা নিসা, আয়াত, ২৯)

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, যার কাছে তার ভাইয়ের হক রয়েছে, তা মান-সম্মানের হোক বা অন্য কিছুর হোক, সে যেন আজই ক্ষমা চেয়ে নেয় (বা পরিশোধ করে মিটমাট করে নেয়)। এমন দিন আসার আগেই, যেদিন কোনো অর্থকড়ি থাকবে না। যদি ব্যক্তির কোনো নেক আমল থাকে তা দিয়ে পাওনাদারের ঋণ বা হক শোধ করা হবে। আর যদি কোনো নেক আমল না থাকে তা হলে পাওনাদারের বা হকদারের পাপের বোঝা সমপরিমাণ তার মাথায় দিয়ে দেয়া হবে।’ -সহীহ বুখারী

এনটি