সূর্যগ্রহণের সময় যে আমল করবেন
প্রতিনিয়ত মহান আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের জানান দেয় যেসব সৃষ্টি তার অন্যতম ও বড় দুটি হলো সূর্য ও চন্দ্র। চন্দ্র-সূর্য থেকে মানুষ বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়। সূর্যের আলোতে যেমন মানুষ উপকৃত হয়। তেমনি চাঁদের স্নিগ্ধ আলো মানুষকে মুগ্ধ করে, অন্ধকার রাতে পথের সন্ধান পাওয়া যায়।
এর পাশাপাশি চাঁদ ও সূর্যের শৃঙ্খলা বিধান, পরিক্রমণ ও বহুমুখী প্রভাব দেখে মানুষ খুব সহজেই বিশ্বাস করতে পারে যে এগুলোরও একজন স্রষ্টা আছেন। কোনো সুনিপুণ কারিগর ছাড়া এগুলো চলতে পারে না। আর তিনিই আল্লাহ, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন এবং নিজ কুদরতে এগুলো পরিচালিত করছেন।
বিজ্ঞাপন
পবিত্র কোরআনে সূর্য-চন্দ্র প্রসঙ্গ
পবিত্র কোরআনে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে সূর্য ও চন্দ্র প্রসঙ্গ। পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই সত্তা, যিনি সূর্যকে কিরণোজ্জ্বল ও চাঁদকে স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত করেছেন।’ -(সুরা ইউনুস : ৫)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি সৃষ্টি করেছি একটি প্রজ্বলিত বাতি।’ -(সুরা নাবা : ১৩) সূর্যের আলোচনায় কোরআনুল কারিমে সব জায়গায়ই ‘প্রজ্বলিত বাতি’, ‘তেজোদীপ্ত’, ‘উজ্জ্বল জ্যোতি’, ‘চমক/ঝলক’, ‘শিখা’ বলা হয়েছে।
পবিত্র কোরআন আরো বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ চাঁদকে স্থাপন করেছেন আলোরূপে, আর সূর্যকে স্থাপন করেছেন প্রদীপরূপে।’ -(সুরা নুহ : ১৬)
আরো বর্ণিত হয়েছে, ‘আর তিনিই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত, দিন, সূর্য ও চাঁদকে; এবং নক্ষত্ররাজিও তারই নির্দেশে নিয়োজিত। নিশ্চয় এতে বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে অনেক নিদর্শন। -(সুরা নাহল, আয়াত ১৬)
বর্তমানে অনেকে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের বিষয়টিকে আনন্দ-ফুর্তি ও উপভোগের উপকরণ মনে করেন। কিন্তু এটি আদৌ উচিত নয়। কারণ, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসময় বিচলিত হয়ে যেতেন এবং বিশেষভাবে আল্লাহ তায়াকে স্মরণ করতেন।
অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন সূর্য ও চাঁদকে, যারা অবিরাম একই নিয়মের অনুবর্তী এবং তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিনকে।’ -(সূরা ইবরাহীম: ৩৩)
পৃথিবীতে প্রায় সময় চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ দেখা দেয়। চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ হলো আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত একটি প্রক্রিয়া। চাঁদ যখন পরিভ্রমণ অবস্থায় কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখন পৃথিবীর কোনো দর্শকের কাছে কিছু সময়ের জন্য সূর্য আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। এটাই সূর্যগ্রহ বা কুসুফ। আর পৃথিবী যখন তার পরিভ্রমণ অবস্থায় চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখনই পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে চাঁদ কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। এটাই চন্দ্রগ্রহণ বা খুসুফ।
নবীজি (সা.) বলেছেন, ...যখন তোমরা সূর্যগ্রহণ দেখবে, তখনই আতঙ্কিত হৃদয়ে আল্লাহ তাআলার জিকির ও ইস্তিগফারে মশগুল হবে।’ -(সহিহ মুসলিম : ১৯৮৯)
নবীজির যুগে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগেও চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ দেখা দিয়েছিল। অন্য সব বিষয়ের মতো এসময় করণীয় আমল শিক্ষা দিয়েছেন তিনি উম্মতকে। বর্তমানে অনেকে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের বিষয়টিকে আনন্দ-ফুর্তি ও উপভোগের উপকরণ মনে করেন। কিন্তু এটি আদৌ উচিত নয়। কারণ, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসময় বিচলিত হয়ে যেতেন এবং বিশেষভাবে আল্লাহ তায়াকে স্মরণ করতেন।
সূর্যগ্রহণ আনন্দের উপলক্ষ নয়
চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের বিষয়টি আনন্দের হলে নবীজি নিজেই তা উপভোগ করতেন এবং উম্মতকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। কিন্তু তিনি এমনটি করেননি। বরং রাসুলুল্লাহ (সা.) সূর্যগ্রহণের সময় নামাজ পড়তেন। আরবিতে সূর্যগ্রহণকে ‘কুসুফ’ বলা হয়। আর সূর্যগ্রহণের নামাজকে ‘সালাতুল কুসুফ’ বলা হয়। দশম হিজরিতে যখন মদিনায় সূর্যগ্রহণ হয়, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা দিয়ে লোকদেরকে নামাজের জন্য সমবেত করেছিলেন।
হাদিসে এসেছে, হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে ছিলাম, এ সময় সুর্যগ্রহণ শুরু হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজের চাদর টানতে টানতে মসজিদে প্রবেশ করলেন এবং আমরাও প্রবেশ করলাম।
তিনি আমাদেরকে নিয়ে সূর্য প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত দু’রাকত নামাজ আদায় করলেন। এরপর তিনি বললেন, কারো মৃত্যুর কারণে কখনো সূর্যগ্রহণ কিংবা চন্দ্রগ্রহণ হয় না। তোমরা যখন সূর্যগ্রহণ দেখবে তখন এ অবস্থা কেটে যাওয়া পর্যন্ত নামাজ আদায় করবে এবং দোয়া করতে থাকবে। -(বুখারি, ৯৮৩)
নবীজির আমল
আরেক হাদিসে হজরত আবু মুসা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.)-এর সময় সূর্যগ্রহণ হলে তিনি এ আশঙ্কায় করলেন যে কিয়ামতের মহাপ্রলয় বুঝি সংঘটিত হবে। তিনি (তাড়াতাড়ি) মসজিদে এলেন। অত্যন্ত দীর্ঘ কিয়াম, দীর্ঘ রুকু, সিজদাসহ নামাজ আদায় করলেন। (বর্ণনাকারী বলেন) আমি নবীজি (সা.)-কে এমন করতে আগে আর কখনো দেখিনি। অতঃপর তিনি বললেন, ‘আল্লাহর প্রেরিত এসব নিদর্শন কারো মৃত্যু বা জন্মের (ক্ষতি করার) জন্য হয় না। যখন তোমরা তা দেখবে, তখনই আতঙ্কিত হৃদয়ে আল্লাহ তাআলার জিকির ও ইস্তিগফারে মশগুল হবে। ’ (সহিহ মুসলিম : ১৯৮৯) অন্য হাদিসে চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণকে আল্লাহর পক্ষ থেকে ভীতি প্রদর্শন হিসেবে উল্লেখ করে তা থেকে দ্রুত উদ্ধারে সদকা করার কথা বলেছেন।
অতএব সূর্যগ্রহণের সময় একে আনন্দ-উপভোগের উপলক্ষ মনে না করে আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত হওয়া উচিত। কারণ এসময়কে আল্লাহর নবী আশঙ্কার মুহুর্ত মনে করতেন। তাই সূর্যগ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত ‘সালাতুল কুসুফ’ পড়া সুন্নত। সূর্যগ্রহণ শেষ হওয়ার আগে নামাজ শেষ করলেও কোনো সমস্যা নেই। তবে সূর্যগ্রহণ চলাকালীন বাকি সময়টুকুতে জিকির, দোয়া, তওবা-ইসতেগফা, দান-সদকার মাধ্যমে কাটানো উত্তম।
এনটি