মুঘল নির্মাণশৈলীর যে মসজিদ এখনো নজর কাড়ে দর্শনার্থীদের
ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উর্বর ভূমি খ্যাত রংপুরে মসজিদের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। এরমধ্যে রয়েছে ছোট বড় কাঁচা, আধা-পাকা দালানের মসজিদ। এছাড়াও শত শত বছরের ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্মৃতিঘেরা বেশ কয়েকটি মসজিদও আছে এই জেলায়। তবে স্থাপত্য ও আভিজাত্যে দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে যেসব মসজিদ, তার একটি কেরামতিয়া জামে মসজিদ।
রংপুর মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র কাচারি বাজার থেকে মাত্র ১০০ গজ দক্ষিণে রংপুর আদালত চত্বর। চত্বর পেরিয়ে একটু সামনে পা বাড়ালেই চোখে পড়বে পুরোনো একটি মসজিদ। পাশেই শ্যামাসুন্দরী খাল। মুন্সিপাড়ার বিশাল মাঠজুড়ে নির্মিত এ মসজিদটিই কেরামতিয়া জামে মসজিদ। মূলত মোগল স্থাপত্যরীতির সঙ্গে বঙ্গীয় রীতির মিশেলে নির্মিত হয় মসজিদটি। এর স্থাপত্য ও আভিজাত্য যে কারো নজর কাড়বে।
বিজ্ঞাপন
বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থ ও উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা গেছে, মোঘল আমলের শেষের দিকে নির্মিত হয় কেরামতিয়া মসজিদ। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে শাহ কারামত আলী জৌনপুরী রহ. ভারত থেকে ইসলাম প্রচারে এলে তার উদ্যোগে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। তার নামানুসারেই এই মসজিদের নাম রাখা হয় কারামতিয়া মসজিদ। তবে স্থানীয়ভাবে কেরামতিয়া জামে মসজিদ নামেই এটি পরিচিত।
এই মসজিদটি ছাড়াও শাহ কারামত আলী জৌনপুরীর উদ্যোগ-প্রচেষ্টায় রংপুর ও এর আশপাশের অনেক স্থানে গড়ে ওঠেছে অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা, খানকা ও সেবাকেন্দ্র।
জানা গেছে, সমতলভূমি থেকে কারামতিয়া মসজিদটির উচ্চতা প্রায় ১৮ ফুট। এর রয়েছে তিনটি গোলাকার গম্বুজ। আটকোনা ড্রামের আকৃতির উপর ভর করে নির্মিত হয়েছে এসব। প্রতিটি গম্বুজের নিচের অংশে রয়েছে মারলন অলঙ্কার এবং ভেতরের দিকে মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে প্রস্ফূটিত পদ্মফুলের উপর কলসমেটিক ফিনিয়াল চূড়া। এর প্রতিটি কোণে অষ্টভুজাকৃতির স্তম্ভ বিদ্যমান। গম্বুজগুলো কুইন্স ও পেনডেন্টি খিলানের আর্চের উপর ভর করে সুকৌশলে নির্মিত। এছাড়া নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে খিলানাকৃতি ও প্যানেলের অলংকারের সঙ্গে সঙ্গে মিনারের উপস্থিতিও শোভা পাচ্ছে।
মসজিদটি আয়তাকারে ৪২ ফিট বাই ১৩ ফিট। এর পূর্ব ও পশ্চিম দেয়ালের প্রস্থ তিন ফুট তিন ইঞ্চি। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালের প্রস্থ দুই ফুট ১০ ইঞ্চি। ভেতরের দিকে মেহরাব, খিলান ও প্রধান ফটকের উভয়পাশে অষ্টকোণাকৃতির স্তম্ভেরও সন্নিবেশ দেখা যায়। স্তম্ভগুলোর উপরের অংশ বিভিন্ন লতাপাতার কারুকাজ শোভিত। এগুলোর নিচের দিকটা কিছুটা কলসের মতো এবং ছাদের কিনারায় বাহারি অলঙ্করণ করা রয়েছে। প্রতিটি প্রবেশদ্বারে মেহরাব ও খিলানের অভ্যন্তরীণ অংশের উপরিভাগে মারলন অলংকরণের সঙ্গে লতাপাতা জড়ানো ফুলের নকশা দিয়ে সুশোভিত করা হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে দরজার আকৃতি লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে নতুন করে মসজিদটি কিছু সংস্কার কাজ করা হচ্ছে।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুন (১৮ মহররম, ১২১৫ হিজরি) ভারতের জৈনপুরে জন্মগ্রহণ করেন শাহ কারামত আলী জৌনপুরী। ১৮৭৩ সালের ৩০ মে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পর এই মসজিদের সামনেই কারামত আলী জৈনপুরী রহ.-কে সমাহিত করা হয়।
তার ইন্তেকালের পর তৎকালীন জমিদার আলা মিয়া ৯৬ শতক জমির উপর পূর্ননির্মান করেন মসজিদ ও মাজার। মসজিদের সম্প্রসারণ করা হলে মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী রহ.-এর সমাধিটি (মাজার) মসজিদের মূল অবকাঠামোর ভেতরে চলে আসে। বর্তমানে মসজিদের পূর্ব দিকে বারান্দার একটু আগ দিয়ে একটি দেয়ালঘেরা কক্ষের ভেতরে কারামত আলী জৈনপুরী রহ.-এর সমাধি রয়েছে। তার মাজার জিয়ারত করতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিনিয়ত দর্শনাথীরা আসেন।
ভারতের জৈনপুর থেকে বাংলাদেশে আসা মাওলানা কারামত আলী রহ. ছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা.-এর বংশের ৩৭তম পুরুষ সুফি ও দরবেশ।
কেরামতিয়া জামে মসজিদের ইমাম মো. শাহাজান মিয়া জানান, স্থানীদের মতে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন মাওলানা কারামত আলী রহ.। তার ইন্তেকালের পর থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকে আসেন মাজার জিয়াতর করতে। কেউ কেউ বিভিন্ন মানতও করে থাকেন।
কেরামতিয়া জামে মসজিদের খতিব মাওলানা বায়েজিদ আহম্মেদ জানান, তিনতলা বিশিষ্ট এই মসজিদে প্রতি শুক্রবার প্রচুর লোকের সমাগম ঘটে। একসঙ্গে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ হাজার মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। এই মসজিদে নারীদের নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন (ইফা) রংপুরের তথ্য মতে, বর্তমানে রংপুর জেলার আটটি উপজেলা, তিনটি পৌরসভা ও একটি সিটি কর্পোরেশন এলাকা মিলে মোট ৫ হাজার ১০৬টি মসজিদ রয়েছে। এরমধ্যে শুধু জামে মসজিদ ৪ হাজার ৮৫৩টি ও পাঞ্জেগানা (ওয়াক্তি) মসজিদ ২৫৩টি রয়েছে। এসব মসজিদের মধ্যে কেরামতিয়া জামে মসজিদ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপত্য নিদর্শনে অন্যতম একটি।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এনটি