বিশ্ব শিক্ষক দিবস
শিক্ষকদের যেভাবে সম্মান দিতে বলেছে ইসলাম
ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক একটি পেশা। পৃথিবীতে যত ভালো কাজ, মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন হয় এর সবই মূলত উত্তম শিক্ষার বদৌলতে হয়ে থাকে। একজন শিক্ষার্থী এসব গুণ তার শিক্ষক থেকেই পেয়ে থাকে।
ইসলামে শিক্ষকের মর্যাদা
বিজ্ঞাপন
শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শেখো। এবং যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো, তাকে সম্মান করো।’ =(আল-মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৬১৮৪)
ইসলামে নবী-রাসুলদের সম্মান সবার ওপর। আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, নবীগণ মানবতার শিক্ষক। তারা মানুষকে আল্লাহ তায়ালার বিধান সম্পর্কে অবগত করেন, ভালো ও মানবতার বিষয়গুলোর শিক্ষা দান করেন।
নবী-রাসুলদের পর মা-বাবাকে সব থেকে বেশি সম্মান দেওয়া হয়। বাবা-মায়ের মতো একজন শিক্ষককেও সম্মান দেওয়া উচিত।
বিজ্ঞজনকে যেভাবে সম্মান করতেন সাহাবিরা
বিখ্যাত সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ফকীহ সাহাবিদের মধ্যে সব থেকে গ্রহণযোগ্য ছিলেন, তিনি কোরআন ও হাদিসের অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। কোরআনের তাফসিরের ক্ষেত্রে উম্মাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বিবেচনা করা হয় তাকে।
এতো উচ্চমাপের ব্যক্তি হওয়ার পরেও তিনি এতোটা সরল ছিলেন যে, হজরত জায়েদ বিন হারেসা আনসারী রা. এর উটের লাগাম নিজ হাতে ধরতেন, এবং বলতেন, আমাদেরকে বিজ্ঞজনদের সাথে এমন আচরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। -(মুসতাদরাক হাকেম, ৩/২৩)
পূর্ববর্তী আলেমরা যেভাবে শিক্ষকদের সম্মান দিতেন
বর্ণিত আছে, ইমাম আহমদ রহ. ইসলামী জ্ঞান, তাকওয়া ও খোদাভীতির দিক দিয়ে তার শিক্ষকের তুলনায় অনেক অগ্রগামী ছিলেন, এরপরেও তিনি কখনো তার শিক্ষকের সামনে বসতেন না, বরং বলতেন, আমাদের শিক্ষকের সামনাসামনি বসার অনুমতি দেওয়া হয়নি। -(তাজকেরাতুস সামে ওয়াল মুতাকাল্লিম, ৭৮)
ইমাম শাফেয়ী রহ. ইমাম মালিক রহ.-এর অন্যতম শিষ্য ছিলেন। তিনি বলেন, আমি যখন ইমাম মালেক রহ.-এর সামনে কিতাবের পৃষ্ঠা উল্টাতাম, তখন অনেক ভদ্রতা ও বিনয়ের সাথে উল্টাতাম, খেয়াল রাখতাম যেন তিনি শব্দ পেয়ে কোনওভাবে বিরক্ত না হন। -(হাওয়ালা সাবেক, ৮৮)
পবিত্র কোরআনেই হজরত মুসা আ. ও হজরত খিজির আ.-এর ঘটনা সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে। হজরত মুসা আ. একজন নবী হওয়ার পরও খিজির আ. এর সব কথা ও আদেশ ধৈর্যসহকারে শুনেছিলেন, এ ঘটনা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে।
শিক্ষকের প্রতি ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর সম্মান
শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়ে ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি তার শিক্ষক হাম্মাদ রহ.-এর বাসার দিকে পা বিছিয়ে বসতেও চাইতেন না। ইমাম আবু ইউসুফ রহ. তার শিক্ষক আবু হানিফা রহ.কে এতোটা ভালোবাসতেন যে, তার সন্তান মারা যাওয়ার পরও তিনি শিক্ষকের ক্লাসে উপস্থিত ছিলেন।
সৌন্দর্য হারাচ্ছে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক!
দুঃখজনকভাবে বর্তমান সময়ে ছাত্র শিক্ষকের মাঝে সেই ভালোবাসা-সৌহার্দ্য ও সম্মান অনেকটাই হারাতে বসেছে। শিক্ষার্থীরা নিজের শিক্ষকের সাথে এমন আচরণ করে যা দেখে মনে হয় শিক্ষক তার বিরোধী ও বিপক্ষের কেউ। ভদ্রতা, সৌজন্য ও সম্মান রক্ষা তো অনেক দূরের বিষয়।
শিক্ষার্থীর প্রতি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর ভালোবাসা
একজন শিক্ষক বাবার মর্যাদাস্থলে থাকেন, তাই শিক্ষকের জন্যও উচিত তিনি নিজের সন্তানকে যেভাবে ভালোবাসেন তার শিক্ষার্থীকেও যেন সেভাবেই ভালোবাসেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. নিজের ছাত্রদের সম্পর্কে বলেছেন, তাদের চেহারায় একটি মাছি বসলেও আমি কষ্ট পাই। -(তাজকিরাতুস সামে, ৯)
আকাবির আলেমরা যেভাবে শিক্ষার্থীদের স্নেহ করতেন
আকাবির আলেমরা তাদের ছাত্রদের সুবিধা-অসুবিধা সবকিছুর পূর্ণ খেয়াল রাখতেন। ইমাম শাফেয়ী রহ. একজন উচ্চ মর্যাদার ফকীহ ও মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি যখন জ্ঞান অর্জনের জন্য মদীনায় এসেছিলেন তখন অনেক দরিদ্র ছিলেন, ইমাম মালেক রহ. তার এই ছাত্রকে নিজের মেহমান বানিয়ে নেন এবং যতদিন তিনি মদীনায় ছিলেন তার সুবিধা-অসুবিধা সব কিছুর দিকে খেয়াল রাখতেন।
ইমাম শাফেয়ী রহ. উচ্চ শিক্ষার জন্য যখন মদীনা থেকে কুফায় যেতে চাইলেন তখন ইমাম মালেক রহ. তার সফর ও খরচের ব্যবস্থা করে দেন। এবং শহর থেকে বের হয়ে এসে তাকে পরম মমতায় বিদায় জানান।
ইমাম শাফেয়ী রহ. কুফায় এসে ইমাম আবু হানিফা রহ. এর শিষ্য ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর ছাত্র হন। এখানে ইমাম মুহাম্মদ তার ছাত্র শাফেয়ী রহ.-এর সব ধরনের খরচ বহন করতেন এবং পূর্ণ সহযোগীতা করতেন।
ইমাম শাফেয়ী রহ. যখন কুফায় এসেছিলেন তখন তার গায়ে একেবারে সাদামাটা একটা কাপড় ছিল, মুহাম্মদ রহ. তাৎক্ষণিক তার জন্য এক হাজার দিরহামের একটি দামি কাপড়ের ব্যবস্থা করেন। এবং শাফেয়ী রহ.-কে বিদায় দেওয়ার সময় তার হাতে নিজের জমানো অর্থ থেকে তিন হাজার দিরহাম দিয়েছিলেন। -( জামিয়ু বয়ানুল ইলম লি ইবনু আব্দিল বির, ২/৮)
এনটি