আশুরার দিনটি মুসলিম উম্মাহর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আরবি ‘আশারা’ শব্দ থেকে আশুরা শব্দটি এসেছে। আশারা অর্থ দশ, আর আশুরা মানে দশম। ইসলামী পরিভাষায় আরবি বর্ষপঞ্জি হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলে। এছাড়াও এ মাসের ১০ তারিখে ১০টি বড় বড় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, সে কারণেও মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়।

আশুরার দিনের ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কারবালা প্রান্তরে (৬০ বা ৬১ হিজরির ১০ মুহাররম) মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র হোসাইন (রা.) মর্মান্তিক শাহাদাত বরণ। এ ঘটনা ‘আশুরা’-কে আরও গুরুত্বপূর্ণ করেছে। ফলে কারবালা ও কারবালা সংক্রান্ত ইতিহাস জরুরি বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

তবে আশুরা মানেই শুধু কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নয়। আশুরার ঐতিহ্য আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে। সুপ্রাচীনকাল থেকে আশুরার ঐতিহাসিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, ইসলামের আবির্ভাবেরও বহু আগ থেকে।

এমনকি ইসলাম পূর্ব সময় থেকে এই দিনে রোজা রাখার প্রচলন চলে আসছে। আশুরার ইতিহাস সম্পর্কে এক হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হিজরত করে মদিনায় পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিন রোজা পালন করছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জিজ্ঞেস করলেন, আশুরার দিন তোমরা রোজা রাখো কেন? তারা উত্তর দিল, এটি একটি মহান দিন—এ দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মুসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। 

তবে আশুরা মানেই শুধু কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নয়। আশুরার ঐতিহ্য আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে। সুপ্রাচীনকাল থেকে আশুরার ঐতিহাসিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, ইসলামের আবির্ভাবেরও বহু আগ থেকে।

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, মুসা (আ.)-কে অনুসরণের ব্যাপারে আমরা তাদের চেয়ে বেশি হকদার। এর পর থেকে তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। (সহিহ বুখারি: ৩৩৯৭; সহিহ মুসলিম: ১১৩৯)। 

কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা ছাড়াও পৃথিবীর ইতিহাসের আশুরা দিনে সংঘটিত ঘটনাগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-

এক. আল্লাহ তায়ালা এ দিন পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তার ইচ্ছায় এ দিনেই কিয়ামত ঘটবে।

দুই. মহান আল্লাহ আদি পিতা আদম (আ.)-কে এই দিন জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠান। আবার এই দিন আল্লাহ তাআলা আদম (আ.)-এর দোয়া কবুল করেন। এছাড়াও এ দিনেই সমগ্র মানবজাতির মা ও আদম (আ.)-এর স্ত্রী হাওয়া (আ.)-এর সঙ্গে আরাফার ময়দানে পৃথিবীতে প্রথম সাক্ষাৎ হয়।

তিন. আল্লাহর নবী নুহ (আ.)-এর জাতির লোকেরা আল্লাহর নাফরমানি করেছিল। বারবার সতর্ক করার পরও তারা আহ্বানে সাড়া না দেওয়ায়, আল্লাহর শাস্তি মহাপ্লাবনে নিপতিত হয়। দীর্ঘ প্লাবন শেষে মহররমের ১০ তারিখে তিনি নৌকা থেকে ঈমানদারদের নিয়ে পৃথিবীতে নেমে আসেন।

কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা। মহররম মাসের ১০ তারিখে এই মর্মন্তুদ দুঃখের অবতারণা হয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আল্লাহর নবী (সা.)-এর নাতি হোসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন। 

চার. আল্লাহর প্রিয়নবী ইবরাহিম (আ.)-কে নমরুদ অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেছিল। তিনি অগ্নিকুণ্ডে ৪০ দিন থাকার পর মহররমের ১০ তারিখ মুক্তি লাভ করেন।

পাঁচ. আল্লাহর নবী আইয়ুব (আ.) ১৮ বছর কঠিন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি এই দিনে মহান আল্লাহর রহমতের পূর্ণ সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্য লাভ করেন।

ছয়. হজরত ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনা সবার কাছে বিখ্যাত। তিনি ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র ছিলেন। তার ১২ জন ভাই ছিল। কিন্তু ১১ ভাই ষড়যন্ত্র করে তাকে কূপে ফেলে দেয়। তবে মহান আল্লাহর অনুগ্রহে এক বণিক দল তাকে উদ্ধার করে। এরপর মিসরে গিয়ে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদ লাভ করেন। এরপর ১০ মহররম দীর্ঘ ৪০ বছর পর তিনি পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

সাত. আল্লাহর আরেক নবী হজরত ইউনুস (আ.)। তিনি জাতির লোকদের প্রতি হতাশ হয়ে পড়েন। এরপর নদী অতিক্রম করে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। পথিমধ্যে মাঝ নদীতে পতিত হন। আর তখন তাকে একটি বড় মাছ গিলে ফেলে। মাছের পেটে তিনি ৪০ দিন ছিলেন। এরপর ১০ মহররম আল্লাহর রহমতে মাছ তাকে নদীর তীরে ফেলে দেয় এবং তিনি মুক্তি লাভ করেন।

আট. বনি ইসরাইলের নবী হজরত মুসা (আ.)। তিনি ফেরাউনের জুলুম থেকে বাঁচতে সঙ্গী-সাথীসহসহ অন্যত্র চলে যান। নীল নদ পার হয়ে নিরাপদে পৌঁছে যান। আর ফেরাউন তার দলবলসহ নদীরে পানিতে ডুবে মারা যায়।

নয়. ঈসা (আ.)-কে তার জাতির লোকেরা হত্যা করার চেষ্টা করে। ফলে মহররমের ১০ তারিখ মহান আল্লাহ তাকে আসমানে উঠিয়ে নেন।

দশ. কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা। মহররম মাসের ১০ তারিখে এই মর্মন্তুদ দুঃখের অবতারণা হয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আল্লাহর নবী (সা.)-এর নাতি হোসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন। শুধু  কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে  ১০ মহররমকে শোকের জন্য বেছে নেওয়া উচিত নয়।’ (ইমদাদুল মুফতিয়িন: ১/৯৬)

এনটি/