খাদ্যসংকট দূর করতে যা মেনে চলতে বলেছেন নবীজি
মহান আল্লাহ দুঃখ যেমন সৃষ্টি করেছেন, সুখও সৃষ্টি করেছেন। অন্ধকারচ্ছন্ন রাত যেমন সৃষ্টি করেছেন, তার পরেই আলোকিত দিন সৃষ্টি করেছেন। ফলে বিপদ-আপদ, অভাব-অনটন মানবজীবনের সঙ্গী। তাই কখনো দুঃখ, কষ্ট, অভাব-অনটন ইত্যাদি এলে একদম ভেঙে পড়া উচিত নয়।
কারণ রাতের পরই আছে দিন, দুঃখের পরই আছে সুখ। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় কষ্টের সঙ্গেই স্বস্তি রয়েছে।’ (সুরা ইনশিরাহ, আয়াত : ০৬)
বিজ্ঞাপন
মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য অভাব-অনটন, বিপদ-আপদ দান করেন। যদি কেউ সে অবস্থায়ও মহান আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস রেখে ধৈর্য ধারণ করে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৫৫)
নবীজি (সা.) ও সাহাবায়ে কিরামের যুগে মাঝে মাঝে খাদ্যসংকট, অভাব-অনটন দেখা দিয়েছিল। তা থেকে উত্তরণের জন্য তাঁরা কোন পথ অবলম্বন করেছেন, নিম্নে সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা হলো-
ধৈর্যসহকারে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া
দুঃসময়ে ধৈর্যধারণও এক ধরনের নেক আমল। খাদ্যসংকট বা দুর্দিনে মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম ধৈর্যসহকারে আল্লাহর সাহায্য চাইতেন। এবং মুমিনদের দুর্দিনে ধৈর্যধারণের দীক্ষা দিয়েছেন। যারা তা করতে পারে, মহান আল্লাহ তাদের প্রশংসা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘ভালো কাজ এটা নয় যে, তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফেরাবে; বরং ভালো কাজ হলো যে ঈমান আনে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি এবং যে সম্পদ প্রদান করে তার প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও নিকটাত্মীয়গণকে, এতিম, অসহায়, মুসাফির ও প্রার্থনাকারীকে এবং বন্দিমুক্তিতে এবং যে সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করে, যারা ধৈর্য ধারণ করে কষ্ট ও দুর্দশায় এবং যুদ্ধের সময়ে। তারাই সত্যবাদী এবং তারাই মুত্তাকি।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৭৭)
কৃষি খাতে মনোযোগ দেওয়া
প্রিয় নবী (সা.)-এর এই শিক্ষাগুলো সাহাবায়ে কিরামও তাদের শাসনামলে প্রয়োগ করেছেন। ফলে দুর্ভিক্ষের কারণে তাদেরও খুব বেশি বিপদে পড়তে হয়নি। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) দুর্ভিক্ষের বছর বলেন, আর সেই বছর ছিল ভীষণ দুর্বিপাক ও কষ্টের। উমর (রা.) পল্লী অঞ্চলের বেদুইনদের উট, খাদ্যশস্য ও তেল প্রভৃতি সাহায্যসামগ্রী পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। এমনকি তিনি গ্রামাঞ্চলের একখণ্ড জমিও অনাবাদি পড়ে থাকতে দেননি এবং তাঁর চেষ্টা ফলপ্রসূ হলো। ওমর (রা.) দোয়া করতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি তাদের রিজিক পর্বতচূড়ায় পৌঁছে দিন।’ আল্লাহ তার এবং মুসলমানদের দোয়া কবুল করলেন। তখন বৃষ্টি বর্ষিত হলে তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ (সব প্রশংসা আল্লাহর)। আল্লাহর শপথ! যদি আল্লাহ এই বিপর্যয় দূর না করতেন, তবে আমি কোনো সচ্ছল মুসলমান পরিবারকেই তাদের সঙ্গে সমসংখ্যক অভাবী লোককে যোগ না করে ছাড়তাম না। যতটুকু খাদ্যে একজন জীবন ধারণ করতে পারে, তার সাহায্যে দুজন লোক ধ্বংস থেকে রক্ষা পেতে পারে। (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৫৬৪)
অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো
কোনো অভাবী ব্যক্তি যাতে ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট না পায় তাই ভাগাভাগি করে খাবার গ্রহণের তাগিদ দিয়েছিলেন নবীজি। এবং কোরবানির ঈদের সময় গোশত সংরক্ষণ করতে নিষেধ করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওয়াকিদ (রা.) বলেন, তিন দিনের ওপরে কোরবানির গোশত খেতে রাসুল (সা.) নিষেধ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর (রহ.) বলেন, আমি বিষয়টি আমরাহ (রা.)-এর কাছে উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ইবনে ওয়াকিদ সত্যই বলেছেন। আমি আয়েশা (রা.)-কে বলতে শুনেছি যে রাসুল (সা.)-এর যুগে ঈদুল আজহার সময় বেদুইনদের কিছু পরিবার শহরে আগমন করে, তখন রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা তিন দিনের পরিমাণ জমা রেখে বাকি গোশতগুলো সদকা করে দাও। পরবর্তী সময়ে লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), মানুষ তো কোরবানির পশুর চামড়া দিয়ে পাত্র প্রস্তুত করছে এবং তার মধ্যে চর্বি গলাচ্ছে। রাসুল (সা.) বলেন, তাতে কী হয়েছে? তারা বলল, আপনিই তো তিন দিনের বেশি কোরবানির গোশত খাওয়া থেকে বারণ করেছেন। তিনি বলেন, আমি তো বেদুইনদের আগমণের কারণে এ কথা বলেছিলাম। অতঃপর এখন তোমরা খেতে পারো, জমা করে রাখতে পারো এবং সদকা করতে পারো। (মুসলিম, হাদিস : ৪৯৯৭)
সংযত জীবনাচারে অভ্যস্ত হওয়া
নবীজি (সা.)-এর যুগে যখন মদিনায় দুর্ভিক্ষ এসেছিল, এই দুর্ভিক্ষ থেকে উম্মতকে বাঁচাতে সবাইকে তিনি জীবনাচারে সংযত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। জাবালা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা মদিনায় কিছুসংখ্যক ইরাকি লোকের সঙ্গে ছিলাম। একবার আমরা দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হই, তখন ইবনে জুবায়ের (রা.) আমাদের খেজুর খেতে দিতেন। ইবনে উমর (রা.) আমাদের কাছ দিয়ে যেতেন এবং বলতেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কাউকে তার ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া একসঙ্গে দুটো করে খেজুর খেতে নিষেধ করেছেন। (বুখারি, হাদিস : ২৪৫৫)
অধিক হারে দোয়া করা
অভাব-অনটন ও দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পাওয়ার আরেকটি করণীয় আমল হলো দোয়া। মহান আল্লাহর কাছে অতীতের গুনাহগুলো থেকে তাওবা করে, পরিস্থিতি অনুকূলে এনে দেওয়ার জন্য দোয়ায় মগ্ন হয়ে যাওয়া। অনেক ক্ষেত্রে দোয়ার মাধ্যমেও অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। নবীজি (সা.) দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি পেতে মহান আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করেছিলেন। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, নবীজি (সা.)-এর যুগে (অতিবৃষ্টির কারণে) মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হলে একদিন জুমার দিন রাসুল (সা.) মিম্বারে উপবিষ্ট হয়ে লোকদের সামনে জুমার খুতবা দিচ্ছিলেন। এক বেদুইন দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, ধন-সম্পদ বরবাদ হয়ে গেল, সন্তান-সন্ততি ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ছে। ...রাসুল (সা.) বলেছেন, হে আল্লাহ, আমাদের চারপাশে, আমাদের ওপর নয়। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর রাসুল (সা.) হাত দিয়ে যেদিকেই ইশারা করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে সেদিকেই ফরসা হয়ে গেছে। এমনকি আমি মদিনাকে আয়নার মতো পরিষ্কার দেখতে পেলাম। এদিকে ‘কানাত’ নামক প্রান্তরে এক মাস ধরে পানির ধারা বয়ে গেল। যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউই এসেছে সে-ই অতিবৃষ্টির সংবাদ দিয়েছে। (মুসলিম, হাদিস : ১৯৬৪)
গুনাহ ছেড়ে দেওয়ার তাগিদ দেওয়া
খাদ্যসংকট কিংবা অভাব-অনটনের একটি কারণ হলো পাপাচার, তাই মহানবী (সা.) তাঁর উম্মতদের সংকট থেকে বাঁচাতে পাপাচার থেকে দূরে থাকার তাগিদ দিতেন। সাওবান (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সৎকর্ম ছাড়া অন্য কিছু আয়ুষ্কাল বাড়াতে পারে না এবং দোয়া ছাড়া অন্য কিছুতে ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। মানুষ তার পাপ কাজের দরুন তার প্রাপ্য রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০২২)
আমাদের উচিত বিশ্বব্যাপী চলমান সংকট ও দ্রুত ধেয়ে আসা অভাব-অনটন থেকে রক্ষা পেতে এখন থেকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া, অপচয় বন্ধ করা, অনাবাদি জমিগুলো ফসল উপযোগী করে তোলা, জলাশয়গুলোতে মাছ চাষ করা, অলস সম্পদগুলো সঠিকভাবে বিনিয়োগ করা এবং ধনী-গরিব সবাই মিলে পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে সংকটের সময় পার করার চেষ্টা করা, এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও অনুকূলে এনে দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহর কাছে খাঁটি দিলে তাওবা করে বেশি বেশি দোয়া করা, ইস্তিগফার করা, সদকা করা। মহান আল্লাহ আমাদের সব ধরনের সংকট ও অভাব-অনটন থেকে রক্ষা করুন। আমিন।