ট্রেডমার্ক বেচা-বিক্রি বিষয়ে শরয়ি বিশ্লেষণ
ব্যবসাবাণিজ্যের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে ট্রেডমার্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মানুষের কাছে এর গুরুত্ব এতটাই বেড়েছে যে, সাধারণ ভোক্তারা ট্রেডমার্ক বা কোম্পানির লোগো দেখে পণ্য খরিদ করে থাকেন। মূলত ট্রেডমার্কটাই ভোক্তাদের আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এ আগ্রহের সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা ট্রেডমার্ক চুরি করে নকল পণ্য বাজারজাত করে। এতে মূল স্বত্বাধিকারীর পণ্য-বিক্রির গতি বিনষ্ট হয়, একই সঙ্গে তার নকল ও নিম্নমানের পণ্য বাজারজাত করার কারণে ব্র্যান্ডের সুনাম নষ্ট হয়।
বাণিজ্যিক মার্কা বা ট্রেডমার্ক বলতে এমন একটি বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র প্রতীককে বোঝায়, যা কোনো পণ্য প্রস্তুতকারক বা ব্যবসায়ী তার পণ্যের বা সেবার গায়ে স্থাপন করে। যথাযথ সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে নিবন্ধিত বাণিজ্যিক মার্কা শুধু নিবন্ধনকারী ব্যবসায়ী ব্যবহার করার একচেটিয়া আইনি অধিকার রাখেন। তবে কোনো কোনো দেশে নিবন্ধন না করেও ব্যবসায়ীরা তাদের বাণিজ্যিক মার্কা সংরক্ষণের ব্যাপারে আইনি সহায়তা পেতে পারেন।
বিজ্ঞাপন
স্বতন্ত্র পণ্যের মালিকানা স্বত্ব দাবি করার জন্য সাধারণত বাণিজ্যিক মার্কা বা ট্রেডমার্ক ব্যবহার করা হয়। স্বত্বাধিকারী ব্যতীত অন্য কেউ কোনো পণ্যের বাণিজ্যিক মার্কা নিয়ে ব্যবসা করলে বা বিজ্ঞাপন দিলে, তা আইনত দ-নীয় অপরাধ। বাণিজ্যিক মার্কার স্বত্বাধিকারী না হয়েও এটি অনুমতিপত্রের মাধ্যমে ব্যবহার করা যেতে পারে। সচরাচর খেলনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিক মার্কার অনুমোদনপত্র লাভের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা ও বিপণন করে থাকে।
বাণিজ্যিক মার্কা বা ট্রেডমার্কের অবৈধ ব্যবহার করে নকল পণ্য বা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে মার্কা চুরি (ট্রেডমার্ক পাইরেসি) বলা হয়। মার্কা চুরির শিকার হলে বাণিজ্যিক মার্কার স্বত্বাধিকারী আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। অধিকাংশ দেশেই স্বত্বাধিকারীকে আইনি সহায়তা পেতে হলে বাণিজ্যিক মার্কার নিবন্ধন করিয়ে নিতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ আরও কিছু দেশে বাণিজ্যিক মার্কার ক্ষেত্রে ‘সাধারণ আইন’ (Common Law) ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে অনিবন্ধিত বাণিজ্যিক মার্কার স্বত্বাধিকারীরাও জালিয়াতির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। তবে অনিবন্ধিত স্বত্বাধিকারীরা সাধারণত নিবন্ধিত স্বত্বাধিকারীদের চেয়ে কম আইনি সহায়তা পেয়ে থাকেন।
ব্যবসাবাণিজ্যের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে ট্রেডমার্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মানুষের কাছে এর গুরুত্ব এতটাই বেড়েছে, সাধারণ ভোক্তারা ট্রেডমার্ক বা কোম্পানির লোগো দেখে পণ্য খরিদ করে থাকেন। মূলত ট্রেডমার্কটাই ভোক্তাদের আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এ আগ্রহের সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা ট্রেডমার্ক চুরি করে নকল পণ্য বাজারজাত করে। এতে মূল স্বত্বাধিকারীর পণ্য-বিক্রির গতি বিনষ্ট হয়, একই সঙ্গে নকল ও নিম্নমানের পণ্য বাজারজাত করার কারণে তার ব্র্যান্ডের সুনাম নষ্ট হয়। তাই মানুষ এসব ট্রেডমার্কের সরকারিভাবে রেজিস্ট্রেশন করে নেয়। যাতে অন্য কেউ ওই মার্ক ব্যবহার করলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। আর যেহেতু রেজিস্ট্রেশনে ব্যাপক ঝক্কি-ঝামেলা পোহানোর সঙ্গে সঙ্গে অর্থও খরচ করতে হয়; তাই পরবর্তী সময়ে আবার এ ট্রেডমার্কগুলোর কেনাবেচাও হয়।
মানুষও নিজেদের পণ্য সহজে প্রচার করার জন্য প্রতিষ্ঠিত ও প্রসিদ্ধ কোম্পানির মার্ক বা লোগো ব্যবহার করতে আগ্রহের সঙ্গে এসব ট্রেডমার্ক খরিদ করে থাকেন। প্রশ্ন হলো, ব্যবসায়িক নাম বা ট্রেডমার্ক বিক্রি করা যাবে কি না? এ কথা জানা যে, ব্যবসায়িক নাম বা ট্রেডমার্ক কোনো দ্রব্যগত বস্তু নয়; বরং তা হচ্ছে একটি হক বা স্বত্ব। সুতরাং ট্রেডমার্ক বিক্রির মাসআলা জানার আগে হক বা স্বত্ব বিক্রির কয়েকটি মূলনীতি আলোচনা করা প্রয়োজন।
১. যেসব স্বত্ব মৌলিকভাবে শরিয়তসম্মত করা হয়নি; বরং মানুষের ক্ষতি বিদূরণের জন্য অনুমোদিত হয়েছে, সেগুলোর বিক্রি করা জায়েজ নয়। আবার সেগুলো সমঝোতা ও অধিকার প্রত্যাহার করার মাধ্যমেও বিনিময়যোগ্য নয়। যেমনÑ প্রতিবেশ-স্বত্ব।
২. যেসব স্বত্ব এই মুহূর্তে বিদ্যমান নেই; বরং ভবিষ্যতে আসার সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলোরও বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ নয়। যেমন- স্বত্বাধিকারীর জীবদ্দশায় উত্তরাধিকার লাভের সম্ভাব্য স্বত্বে বিনিময় গ্রহণ করা।
৩. যেসব স্বত্ব স্বত্বাধিকারীর জন্য শরিয়তের পক্ষ থেকে প্রমাণিত; কিন্তু সেসব স্বত্ব স্থানান্তরযোগ্য নয়, এ জাতীয় সত্ত্বের ক্রয়-বিক্রয়ও জায়েজ নয়। তবে সমঝোতার ভিত্তিতে অথবা অধিকার প্রত্যাহারের ভিত্তিতে বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ। যেমনÑ কিসাস গ্রহণের অধিকার।
৪. যেসব স্বত্ব কোনো অস্তিত্বমান বস্তুর সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং স্থায়ী সুযোগসুবিধা বলে গণ্য হয়, যেমন- রাস্তায় চলাচল-স্বত্ব, এ জাতীয় স্বত্বের বেচাকেনা করা গ্রহণযোগ্য অভিমত অনুযায়ী জায়েজ।
৫. কিছু জিনিসকে মাল হিসেবে গণ্য করার ক্ষেত্রে সামাজিক প্রচলনের বিরাট প্রভাব রয়েছে।
এবার মূল বিষয়টি আলোচনা করা যাক। এখানে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, ট্রেডমার্ক কোনো দ্রব্যজাতীয় বস্তু নয়। বরং মার্ক বা লোগো ব্যবহারের অধিকার মাত্র। এ স্বত্ব¡টি বর্তমানে উপস্থিত, অন্যত্র স্থানান্তর করা যায় এমন। সুতরাং আগের ১নং নিয়ম অনুযায়ী অধিকার প্রত্যাহারের ভিত্তিতে ট্রেডমার্কের বিনিময় গ্রহণ করার অবকাশ থাকলেও তা বেচাকেনা করা যাবে না। কারণ এটি দ্রব্য জাতীয় স্বত্ব নয়। আল্লামা থানভি (রহ.) এভাবেই ফতোয়া দিয়েছেন।
কিন্তু বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আল্লামা মুফতি তাকি উসমানী এ ক্ষেত্রে ভিন্ন মত পেশ করেছেন। তার মতে, ব্যবসায়িক নামের স্বত্ব ও ট্রেডমার্ক স্বত্ব যদিও এটি একটি নিরেট স্বত্ব, যা কোনো বস্তুগত ইন্দ্রিয়ানুভূত বস্তুর মাঝে বিদ্যমান নয়। কিন্তু এ স্বত্ব লাভ করতে সরকারি রেজিস্ট্রেশনের পেছনে বিরাট দৌড়ঝাঁপের প্রয়োজন হয় এবং সীমাহীন কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা গুনতে হয়। যার পরই এ ব্যবসায়িক লোগো বা ট্রেডমার্কের একটি আইনগত ভিত্তি সৃষ্টি হয়।
সুতরাং ব্যবসায়ীদের পরিভাষায়ও এটি একটি বস্তুগত উপাদান স্বত্বের রূপ ধারণ করে। সুতরাং ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে তার বিনিময় গ্রহণ জায়েজ হওয়া উচিত। আর এ বিষয়েও কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, কোনো কোনো জিনিস অস্তিত্বমান বস্তুতে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে সামাজিক প্রচলনের বিরাট প্রভাব ও দখল রয়েছে। কেননা আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (রহ.) এর বক্তব্য অনুযায়ী মানুষের স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমেই পণ্য পণ্য হিসেবে সাব্যস্ত হয়। এর একটি উপমা হলো গ্যাস ও বিদ্যুৎ। অতীতকালে এগুলোকে মাল এবং অস্তিত্বমান বস্তু হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হতো না। কেননা এ দুটি জিনিস এমন কোনো বস্তুগত উপাদান নয়, যা স্ব অস্তিত্বে বিদ্যমান থাকতে পারে। আর মানুষের জন্য এগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণও এক দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। কিন্তু বর্তমানে এ উভয় জিনিস ওইসব মূল্যবান বস্তুর অন্তর্ভুক্ত, যার ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ সংশয় নেই। কেননা এ দুই জিনিসে অভাবনীয় মুনাফা রয়েছে। আর বর্তমানে এগুলো পরিহার করে চলাও এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। মানুষের পরিভাষায় এ দুই জিনিস মাল এবং মূল্যবান বস্তু হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ঠিক তদ্রুপ ব্যবসায়িক নাম ও ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন করার পর ব্যবসায়ীদের পরিভাষায় তা বিরাট মূল্যবান বস্তু হিসেব পরিগণিত হয়।
এছাড়া সরকারিভাবে লিখিত সার্টিফিকেট প্রাপ্তির মাধ্যমে তাতে মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। কেননা প্রত্যেক বস্তুর মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ তার অবস্থার প্রেক্ষিতে হয়ে থাকে। সুতরাং বর্তমানে এসব ট্রেডমার্ক বিক্রি জায়েজ হওয়া উচিত।
লেখক : গবেষক, এমিরেটস সেন্টার ফর স্ট্র্যাটিজিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ (ইসিএসএসআর)