শবে কদর কি প্রতি বছর একই দিনেই হয়?
শবে কদর বছরের শ্রেষ্ঠ রাত। এই রাত হাজার বছরের চেয়ে উত্তম। রমজানের শেষ দশকের কোনো এক রাতে এই পবিত্র রজনী। নির্দিষ্ট করে লাইলাতুল কদর চিহ্নিত করা হয়নি। শবে কদর আসলে কোন্ রাত— এ বিষয়ে বিভিন্ন হাদিস সামনে রেখে শীর্ষ মুহাদ্দিস ইমামগণ বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন।
প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ ইমাম ইবনু হাজার আসকালানি (রাহ.) তার জগদ্বিখ্যাত সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারি’-তে লাইলাতুল কদরের তারিখ নিয়ে আলিমগণের অনেকগুলো মতামত ব্যক্ত করেছেন।
বিজ্ঞাপন
রমজানের ২১ তম রাত কি শবে কদর?
ইমাম তিরমিজি (রহ.) তার সুনানে লিখেছেন, ইমাম শাফিঈ ২১ তম রাতকে কদরের রাত মনে করতেন। তার মতের পক্ষে দলিল হলো আবু সা‘ঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস। তিনি বলেন, আমরা নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রামাদানের মধ্য দশকে ইতিকাফ করি। তিনি ২০ তারিখ সকালে বের হয়ে আমাদের সম্বোধন করে বলেন, ‘‘আমাকে কদরের রাত দেখানো হয়েছিলো; পরে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে তার সন্ধান করো। আমি দেখতে পেয়েছি যে, আমি (ঐ রাতে) কাদা-পানিতে সিজদা করছি। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসুলের সাথে ইতিকাফ করেছে, সে যেন ফিরে আসে (অর্থাৎ মাসজিদ থেকে বের না হয়)।’’ আমরা সবাই ফিরে আসলাম। আমরা আকাশে হালকা মেঘ খণ্ডও দেখতে পাইনি। (২১ তারিখ রাতের) পরে এমনভাবে মেঘ দেখা দিলো ও জোরে বৃষ্টি হলো যে, খেজুরের শাখায় তৈরি মসজিদের ছাদ হতে পানি ঝরতে লাগলো। সালাত শুরু হলে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাদা-পানিতে সিজদা করতে দেখলাম। পরে তাঁর কপালে আমি কাদার চিহ্ন দেখতে পাই। (অর্থাৎ, নবিজির স্বপ্ন সত্য হয়েছে) (বুখারি, হাদিস : ২০১৬)
মুহাদ্দিসগণ অনেকেই এই হাদিস থেকে ব্যাখ্যা করেছেন যে, সে বছর কদর হয়েছিল ২১ তম রাতে। (মুফতি আমিমুল ইহসান (রাহ.) সংকলিত, ড. আব্দুল্লাহ্ জাহাঙ্গীর (রাহ.) অনূদিত ফিকহুস সুনান গ্রন্থে (১/৪৮০) এই বিষয়টি টীকায় উল্লেখিত হয়েছে)
রমজানের শেষ সাত রাতে শবে কদর
আরেকদল আলিমের মতে, এটি শেষ সাত রাতের কোনো এক রাতে। তাদের পক্ষে দলিল হলো ইবনু উমার (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস। বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘‘তোমরা রামাদানের শেষ দশকে কদরের রাত অনুসন্ধান করো। তোমাদের কেউ যদি দুর্বল অথবা অপারগ হয়ে পড়ে, তবে সে যেন শেষ সাত রাতে অলসতা না করে।’’ (মুসলিম, হাদিস : ২৬৫৫)
রমজানের ২৩ তম রাত কি শবে কদর?
সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু উনাইস (রা.) রমজানের ২৩ তম রাতকে কদরের রাত মনে করতেন। (মুসলিম, হাদিস : ২৬৬৫)
শবে কদর কি ২৪ তম রাতে?
তাবিঈ ইকরামা (রহ.) বলেন, সাহাবি আবদুল্লাহ্ ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত যে, ‘তোমরা ২৪ তম রাতে (কদর) তালাশ করো।’ (বুখারি, হাদিস : ২০২২)
রমজানের ২৭ তম রাত শবে কদর
আলেমদের বিরাট আরেক জামাত বলেছেন, এটি রমজানের ২৭ তম রাতে। এই মত দিয়েছেন উবাই ইবনু কাব (রা.), ইবনু আব্বাস (রা.), উমার (রা.), ইমাম আবু হানিফা (রাহ.)-সহ অনেকেই। এই মতের পক্ষে দলিল হলো, সাহাবি উবাই ইবনু কাব (রা.) কসম খেয়ে বলতেন, ২৭ তম রাতটি লাইলাতুল কদর। (মুসলিম, হাদিস : ২৬৬৮)
শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাত লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (বুখারি, হাদিস : ২০১৭)
জোড় রাতেও হতে পারে শবে কদর
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহ.) একটি বিশুদ্ধ হাদিসের আলোকে বলেছেন, যদি রমজান মাস ৩০ দিনে হয়, তবে শেষ দশকের জোড় রাতগুলোতেও কদর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা (কদর) সন্ধান করো (শেষ দশকের) অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) নবম রাতে, অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) সপ্তম রাতে, অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) পঞ্চম রাতে, অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) তৃতীয় রাতে এবং অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) শেষ রাতে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৭৯৪)
এ হাদিস থেকে আমরা দেখতে পারি যে, যদি রমজান মাস ৩০ দিনের হয়, তাহলে অবশিষ্ট নবম রাতটি হবে রমজানের ২২ তম রাত, অবশিষ্ট সপ্তম রাতটি হবে ২৪ তম রাত, অবশিষ্ট পঞ্চম রাতটি হবে ২৬ তম রাত এবং অবশিষ্ট তৃতীয় রাতটি হবে ২৮ তম রাত। আর এভাবেই বিশিষ্ট সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি (রা.) কদরের রাত সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন। (এই গণনা শেষ দিক থেকে করা হয়েছে। হাসান বাসরি (রাহ.) থেকেও এভাবে গণনার পক্ষে দলিল রয়েছে)
অন্য দিকে, যদি রমজান মাস ২৯ দিনের হয়, তাহলে উক্ত হাদিস অনুযায়ী কদরের রাত পড়বে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে। অতএব, ঈমানদারদের উচিত, রামাদানের শেষ দশকের প্রতিটি রাতেই লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করা। (মাজমুউ ফাতাওয়া: ২৫/২৮৪-২৮৫)
রমজানের ২৯ দিনে হলে বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদর হবে। আর রমজানের ৩০ দিনে হলে জোড় রাতেও কদর হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা থাকবে।
কদর যে জোড় রাতেও হতে পারে, তার একটি প্রমাণ হলো সাহাবি ইবনু আব্বাস (রা.)-এর বক্তব্য। তাবিঈ ইকরামা (রাহ.) ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, ‘তোমরা ২৪ তম রাতে (কদর) তালাশ করো।’ (বুখারি, হাদিস : ২০২২)
২৪ তম রাতের ব্যাপারে হাসান সনদের একটি মারফু হাদিস (সরাসরি নবিজি থেকে বর্ণিত হাদিস) সংকলন করেছেন ইমাম আহমাদ ও তাবারানি (রাহিমাহুমাল্লাহ)।
গত শতাব্দির প্রখ্যাত ফকিহ ও মুহাদ্দিস শায়খ ইবনু উসাইমিন (রাহ.)-ও বলেছেন, জোড়-বেজোড় যেকোনো রাতেই কদর হতে পারে। (শারহুল মুমতি: ৬/৪৯২)
এজন্য আমরা হাদিসে দেখি, নবীজি শুধু বেজোড় রাতে নয়, শেষ দশকের প্রতিটি রাতেই ইবাদত করতেন। আয়িশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (রমাদানের) শেষ দশকে যে পরিমাণ আমল করতেন, অন্য কোনো সময়ে সে পরিমাণ আমল করতেন না।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৬৭৮)
তবে, কোনো সন্দেহ নেই যে, কদরের রাত বিজোড় রাতে হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে অনেক হাদিস এসেছে। তাই, আমরা বিজোড় রাতগুলো বেশি গুরুত্ব দেবো, তবে জোড় রাতগুলোতে অবহেলা করবো না। কারণ জোড় রাতগুলোতেও কদর হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে, ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহ.) এবং অন্য আলিমগণ জোড় রাতে হওয়ার পক্ষে যেভাবে হাদিসটির অর্থ করেছেন, অধিকাংশ আলিম তেমনটি করেননি। পূর্বসূরি নেককার (সালাফ)-গণের বড় অংশ কেবল বিজোড় রাতের পক্ষে মত দিয়েছেন।
রমজানের শেষ দশ রাতে শবে কদর
অধিকাংশ আলিমের মতে, এটি রমজানের শেষ দশকে রয়েছে। তাঁরা জোড়-বিজোড় নিয়ে এত কথা বলেননি। তাদের পক্ষে দলিল হলো- রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা রামাদানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (বুখারি, হাদিস : ২০২০)
হাদিসগুলোর মাঝে সমন্বয় ও সমাধান
■ বিখ্যাত ইমামদের অনেকেই হাদিসের এসব বিভিন্নতার কারণে সবগুলো হাদিসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে বলেছেন, শেষ দশ রাতের যেকোনো রাতে কদর হয়, তবে তা প্রতি বছর নির্দিষ্ট একটি দিনে হয় না; বরং এটি বিভিন্ন বছরে ভিন্ন ভিন্ন দিনে হয়। ইমাম মালিক, আহমাদ, ইসহাক, সুফিয়ান সাওরি, ইবনু তাইমিয়্যাহ, ইমাম নববি, ইবনু হাজার, ইবনু উসাইমিন (রাহিমাহুমুল্লাহ্) এই মত দিয়েছেন। তাঁরা সবাই ছিলেন তাঁদের নিজ নিজ সময়ের শ্রেষ্ঠ ইমাম ও মুহাদ্দিস। শুধু তাঁরাই নন, আলিমগণের বিরাট এক জামাত এই মতটি সমর্থন করেছেন। এই মতটি মেনে নিলে হাদিসগুলোর মাঝে কোনো বিরোধ বা পরস্পরবিরোধিতা থাকে না।
■ সাহাবিগণের ছাত্র তাবিঈ আবু কিলাবাহ (রাহ.) বলেন, ‘লাইলাতুল কদর শেষ দশকের মাঝে স্থানান্তরিত হয়।’ (তিরমিজি, আস-সুনান: ৭৯২ [ফুটনোট])
■ বিভিন্ন হাদিস থেকে বোঝা যায়, রামাদানের ২১, ২৩, ২৪ ও ২৭ তম রাত অধিক সম্ভাবনাময়। তাই, এই রাতগুলোতে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। যদিও শেষ দশকের প্রতিটি রাতেই কদর হতে পারে। এমনকি জোড় রাতগুলোতে হওয়ারও কিছুটা সম্ভাবনা রয়েছে।
■ মুহাদ্দিসগণ বলেন, লাইলাতুল কদরের রাতটি গোপন রাখার উদ্দেশ্য হলো, যাতে মানুষ শেষ দশকের প্রতিটি রাতকেই কদরের রাত মনে করে ইবাদত করে। হাদিসেও এমনটি এসেছে যে, নবিজিকে কদরের রাতটির কথা তার অন্তর থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়, ফলে তিনি সেটি ভুলে যান। তখন তিনি বলেন, ‘‘হয়তো এর মধ্যেই তোমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে।’ (বুখারি, হাদিস : ২০২৩)
আল্লাহ তাআলা আমাদের শবে কদর লাভের এবং ইবাদত-বন্দেগিতে শবে কদর কাটানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।