দোয়া ইউনুস পড়লে বিপদ কাটে
মুসলিমদের জন্য দোয়া ইউনুস বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো সংকট ও অস্থিতিশীল সময়ে এই দোয়া পড়া সুন্নত। আল্লাহর নবী ইউনুস (আ.) বিপদে পড়ে বারবার এই দোয়া পড়েছিলেন। তখন আল্লাহ তার দোয়া কবুল করে তাকে সংকট থেকে মুক্তি দিয়েছেন।
পুরো ঘটনার প্রেক্ষাপট ও দোয়া ইউনুসের ফজিলত-আমল নিয়ে পাঠকদের জন্য আমাদের আয়োজন-
বিজ্ঞাপন
মাছের পেটে ইউনুস (আ.)
ইউনুস আলাইহিস সালাম একজন সম্মানিত নবী। কোরআনের ১০ নম্বর সুরার নামকরণ তার নামে। অন্যান্য নবীদের মতো তারও সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল, আল্লাহর প্রতি তার জাতিকে আহ্বান করা। তাওহিদ ও পরকালের কথা পৌঁছিয়ে দেওয়া।
কিন্তু এই কাজটা অতটা সহজ ছিল না। ইউনুস (আ.)-এর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের উপাসনা ছেড়ে অদ্বিতীয় আল্লাহ কাছে ফিরে আসতে তিনি তাদের আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু তারা তার ডাকে সাড়া দেয়নি। এতে নিরাশ হয়ে তিনি তাদের ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। (তুরুকুল ইসলাম, লা-ইলা-হা ইল্লা আনতা; ২০-০৮-২০২০)
পথিমধ্যে আল্লাহ তাআলা তাকে পরীক্ষা করেন। তিনি সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হলে একটি বিশাল মাছ তাকে গিলে ফেলে। তবে আল্লাহ তাআলার রহমতে মাছটি তাকে হজম করতে পারেনি। এমনকি তার দেহের সামান্যতম অংশেও কোনোরূপ ক্ষতের সৃষ্টি করেনি।
সেই মাছের উদর-অন্ধকারে বসে ইউনুস (আ.) অত্যন্ত বিনয়-নম্রতা ও কাতরস্বরে আল্লাহর কাছে অনবরত দোয়া করতে শুরু করেছিলেন। তিনি যে দোয়াটি পড়েছিলেন, তা দোয়া ইউনুস নামে সবার কাছে পরিচিত।
আল্লাহ তাআলা তার কাহিনি বর্ণনা করে বলেন,
‘মাছওয়ালার কথা স্মরণ করুন; তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন। অতঃপর মনে করেছিলেন যে, আমি তাকে পাকড়াও করবো না। অতঃপর তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহবান করলেন- তুমি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই; তুমি পবিত্র, আমি গুনাহগার। (সুরা আম্বিয়া, আয়াত :৮৭)
মাছের পেটের কাহিনি
পবিত্র কোরআনে কারিমে ইউনুস (আ.)-এর নামে একটি সুরা রয়েছে। তেমনি ‘ইউনুস’ নামটিও পাঁচ স্থানে উল্লেখ হয়েছে। ইউনুস (আ.)-কে কোরআনে ‘জুন্নুন-সাহিবুল হূত’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। জুন্নুন শব্দের অর্থ মাছের সঙ্গে সম্পৃক্ত আর সাহিবুল হূত শব্দের অর্থ মৎস্য সহচর বা মাছওয়ালা।
আল্লাহর নবী ইউনুস (আ.) নিনেভায় প্রেরিত হন। এটি তৎকালীন ইরাকের মসুলে অবস্থিত। তিনি নিনেভার লোকজনকে আল্লাহর দিকে ডেকেছিলেন। কিন্তু তারা তার ডাকে সাড়া না দেয়নি। এতে তিনি মর্মাহত হয়ে তাদের আল্লাহর গজবের খবর দেন। এবং আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা না করে নিনেভা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে রওনা হন।
পথিমথ্যে সম্মুখে সমুদ্র পড়লে, তা পাড়ি দেওয়ার জন্য তিনি একটি জাহাজে ওঠেন। জাহাজটি মাঝসমুদ্রে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে। তখন জাহাজের চালক ধারণা করে যে, জাহাজে কোনো অপরাধী আছে, যে জাহাজের জন্য বিপাক ডেকে এনেছে। পরে সেকালের নিয়ম অনুযায়ী লটারির ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু লটারিতে বারবার ইউনুস (আ.)-এর নাম ওঠে। তখন বাধ্য হয়ে তাকে সমুদ্রে ফেলে দিলে জাহাজটি বিপাক থেকে রক্ষা পায়, আর একটি বিরাট মাছ তাকে গিলে ফেলে। (ফাতহুল বারি, খণ্ড : ১০, পৃষ্ঠা : ২১২)
এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
‘ইউনুসও রাসুলদের একজন ছিল। স্মরণ করো, যখন সে পালিয়ে বোঝাই নৌযানে পৌঁছল, অতঃপর সে লটারিতে যোগদান করে পরাভূত হলো। পরে একটি মাছ তাকে গিলে ফেলে, তখন সে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। সে যদি আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা না করত, তাহলে তাকে কিয়ামত পর্যন্ত ওই উদরে থাকতে হতো।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত : ১৩৯-১৪৪)
ইউনুস (আ.) অক্ষত অবস্থায় সেই বৃহদাকার মাছের উদরে ৪০ দিন ছিলেন। সেখানে তিনি তাসবিহ-তাহলিল ও তওবা-ইস্তিগফার করেছিলেন। আল্লাহর অনুমতি বিনে স্বদেশ ত্যাগ করার কারণে অনুশোচনাদগ্ধ হয়ে কান্নাকাটি করেছিলেন।
আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নবীকে পরীক্ষা করেছেন। ইউনুস (আ.) পরীক্ষার অংশ হিসেবে মাছের উদরের নিকষকালো অন্ধকারে ৪০ দিন অবস্থান করেন। ভীষণ কষ্টের মধ্যে থেকে তিনি আল্লাহপ্রেমের তাঁর আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তখন আমি তার (ইউনুসের) ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা থেকে উদ্ধার করেছিলাম। আর এভাবেই আমি মুমিনদের নাজাত দিয়ে থাকি।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৮৮)
৪০ দিন পর আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন। আল্লাহর হুকুমে মাছটি তাকে সমুদ্রের কিনারে উগরে দেয়। কোরআনে কারিমে তার মুক্তি পাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-
‘অতঃপর আমি ইউনুসকে এক বিস্তীর্ণ-বিজন প্রান্তরে নিক্ষেপ করালাম এবং তখন তিনি রুগ্ন ছিল। আর আমি তার ওপর লতাবিশিষ্ট একটি লাউগাছ উদ্গত করলাম। এবং তাকে লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি প্রেরণ করলাম। অতঃপর তারা ঈমান এনেছিল, অতঃপর আমি তাদের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবনোপভোগ করতে দিলাম।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত : ১৪৫-১৪৮)
উল্লেখ্য যে, দীর্ঘ ৪০ দিন মাছের পেটে পানি-খাদ্যবিহীন থাকায় ইউনুস (আ.) ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েন এবং তার চেহারা ফ্যাকাসে এবং হয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থা থেকে নিরাময়ের জন্য আল্লাহ তাআলা পরিবেশ দূষণমুক্তকারী এবং নির্মল ছায়াদানকারী লাউগাছ সেখানে গজিয়ে দেন। সেই লাউগাছটি এত দ্রুত গজিয়ে ওঠে যে, মুহূর্তের মধ্যে ঘন লতাপাতায় তা তাবুর আকার ধারণ করে। তিনি কচি লাউ খাবার হিসেবে গ্রহণ করেন। (কিসসাতু নুহ (আ.), মুহতাভিয়াত; ২৪ মার্চ, ২০২০)
ইউনুস (আ.)-এর সেই দোয়া
আরবি :
لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ، إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
দোয়া ইউনুসের বাংলা উচ্চারণ : লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ-লিমিন।
অর্থ : তুমি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তুমি পবিত্র সুমহান। আমি নিশ্চয়ই জালিমদের দলভুক্ত।
দোয়া ইউনুস পাঠের ফজিলত
দোয়া ইউনুসের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহর নবী ইউনুস (আ.) এই দোয়া পাঠ করেই আল্লাহর রহমতে মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। যদি কেউ দোয়া ইউনুস কয়েকবার পড়ে দোয়া করে তার দোয়া কবুল হয়। কেউ যদি বিপন্ন বা বিপদগ্রস্ত অবস্থায় এই দোয়া পাঠ করে, আল্লাহর রহমতে সে বিপদ থেকে উদ্ধার পায়।
সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! এই দোয়ার গ্রহণযোগ্যতা কি কেবল ইউনুস (আ.)-এর জন্যই প্রযোজ্য, না সব মুসলিমের জন্য? জবাবে প্রিয়নবী (সা.) বলেন,
তাৎক্ষণিকভাবে তার জন্য দোয়াটি বিশেষভাবে কবুল হলেও এটা সব মুসলিমের জন্য সবসময় কবুলের ব্যাপারে প্রযোজ্য। তুমি কি কোরআনে পাঠ করোনি, ‘ওয়া কাজালিকা নুনজিল মুমিনিন- আর এভাবেই আমি আল্লাহ মুমিনদের উদ্ধার করে থাকি।
(তিরমিজি, হাদিস : ৩৫০৫)
বিভিন্ন বর্ণনায় রয়েছে, দৈনিক এক হাজার বার দোয়া ইউনুস পড়লে পদমর্যাদা সমুন্নত হয়। আল্লাহ তার রুজি-রোজগারে সমৃদ্ধি দান করেন। দুঃখ-যন্ত্রণা, পেরেশানি, অশান্তি ও কষ্ট-প্রভৃতি দূর করেন। তার জন্য সব রকম কল্যাণের দ্বার খুলে দেন। শয়তানের প্ররোচনা থেকে তাকে রক্ষা করেন।
এ দোয়া এক লাখ পঁচিশ হাজার বার পড়লে (যেটা খতমে ইউনুস হিসেবে পরিচিত) সব ধরনের অপকার থেকে রক্ষা, বিপদ-আপদ থেকে দূরে থাকা এবং রোগ-শোক থেকে রক্ষা পাওয়া যায় বলে বিভিন্ন বর্ণনায় রয়েছে।