শাবান মাসের আমল ও ফজিলত
শাবান মাস হিজরি চান্দ্রবর্ষের অষ্টম মাস। আরবিতে এ মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআজজম’ অর্থ মহান শাবান মাস। শাবান মাসে মুসলমানদের মধ্যে খুশি-আনন্দ ও সংবেদন-চৈতন্যের আভা ছড়িয়ে পড়ে। শাবান শব্দের অর্থ দূরে ও কাছে, মিলন ও বিচ্ছেদ।
শাবানের আরেকটি অর্থ হলো মধ্যবর্তী সুস্পষ্ট। যেহেতু এ মাসটি রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী, তাই এই মাসকে শাবান মাস নামকরণ করা হয় (লিসানুল আরব, ইবনে মানজুর রহ.)। এসময় বছরের শ্রেষ্ঠ মাস পবিত্র রমজানের আগমনী বার্তা মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে যায়। আহ্লাদের ভিন্ন রকম হিল্লোল দেখা দেয় সবার কাজে-কর্মে ও আচরণ-উচ্চারণে।
বিজ্ঞাপন
এক. শাবান মাসে কিবলা পরিবর্তন হয়
মুসলমানদের প্রথম কিবলা ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। মিরাজের রাতে মুসলমানদের ওপর নামাজ ফরজের পর থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে নামাজ আদায় করতেন তারা। মুহাম্মদ (সা.) হৃদয় দিয়ে চাইতেন, কাবাঘর হোক মুসলমানদের কিবলা। পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর বানানো ঘর হোক সেজদার নিদর্শন। এজন্য মুহাম্মদ (সা.) নামাজে দাঁড়িয়ে বারবার আকাশের দিকে তাকাতেন। মনের আকুল প্রার্থনা ব্যক্ত করতেন।
১৬ মাস পর বায়তুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে কাবাঘর কিবলা হিসেবে ঘোষিত ও নির্ধারতি হয় এই মাসে। কোরআনে বাঙ্ময় হয়েছে এভাবে, ‘বারবার আপনার আকাশের দিকে মুখমণ্ডল আবর্তন আমি অবশ্যই লক্ষ করি। সুতরাং কিবলার দিকে আপনাকে প্রত্যাবর্তন করে দেব, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন। অতএব আপনি মসজিদুল হারামের (কাবাঘর) দিকে চেহারা ঘোরান। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, ওই (কাবা) দিকেই মুখ ফেরাও।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৪৪)
দুই. শাবানে রাসুল (সা.) নফল রোজা রাখতেন
রমজানের রোজা মুসলমান, বালেগ, সুস্থ মানুষের ওপর ফরজ। রমজান ছাড়া ভিন্ন মাসে ফরজ রোজা নেই। তবে অন্য মাসে ও বিশেষ দিনে নফল রোজা রাখায় সওয়াব রয়েছে। রাসুল (সা.) ও সেসব নফল রোজা রাখতেন। সাহাবিদের উদ্বুদ্ধ করতেন। রাসুল (সা.) শাবান মাসে সবচেয়ে বেশি নফল রোজা রাখতেন। অন্য কোনো মাসে এ পরিমাণ রোজা রাখতেন না।
উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (সা.) শাবান মাসের চেয়ে বেশি রোজা কোনো মাসে রাখতেন না। তিনি পুরো শাবান মাসই রোজা রাখতেন এবং বলতেন, তোমাদের মধ্যে যতটুকু সামর্থ্য আছে ততটুকু (নফল) আমল করো, কারণ তোমরা (আমল করতে করতে) পরিশ্রান্ত হয়ে না পড়া পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা (সওয়াব) দান বন্ধ করেন না। নবী (সা.)-এর কাছে সর্বাপেক্ষা পছন্দনীয় নামাজ ছিল তা-ই, যা যথাযথ নিয়মে সর্বদা আদায় করা হতো, যদিও তা পরিমাণে কম হতো এবং তিনি যখন কোনো (নফল) নামাজ আদায় করতেন পরে তা অব্যাহত রাখতেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৭০)
আরও পড়ুন : রমজানের চাঁদ দেখে খুশি হতেন মহানবী (সা.)
নবী করিম (সা.) শাবান মাসে অধিকহারে নফল রোজা রাখতেন। উম্মে সালমা (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে শাবান ও রমজান মাস ছাড়া অন্য কোনো দুই মাস একাধারে রোজা রাখতে দেখিনি। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৩৬)
তিন. বরকত হাসিলের দোয়া করা
রাসুল (সা.) রজব ও শাবান মাসব্যাপী বেশি বেশি বরকত হাসিলের দোয়া করতেন। রমজান মাসে ইবাদত করার সুযোগ ভিক্ষা চাইতেন। তিনি এ দোয়া বেশি বেশি পড়তেন
আরবি :
اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي رَجَبٍ، وَشَعْبَانَ، وَبَلِّغْنَا رَمَضَانَ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাদান
অর্থ : হে আল্লাহ! রজব মাস ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন; রমজান আমাদের নসিব করুন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৫৯)
চার. শাবান মাসে ১৫ তারিখ শবে বরাত
শাবান মাসের অর্ধেকের রজনী মুক্তির রজনী। রোজা রাখার দিবস। এই রাতে বান্দার গুনাহ মাফ করা হয়। অভাবীকে রিজিক দেওয়া হয়। বিপন্মুক্ত করা হয় বিপদগ্রস্তকে। এই রাতকে ‘শবেবরাত’ বলা হয়। ‘শব’ শব্দটি ফার্সি। এর অর্থ রাত। ‘বারাআত’ শব্দটি আরবি। অর্থ : মুক্তি। তথা জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত হলো ‘শবেবরাত’। ‘শবেবরাতকে হাদিসের পরিভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বলা হয়। এই রাতে আল্লাহতায়ালা সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর আসমানে নেমে আসেন। বান্দাকে ডাকতে থাকেন। বান্দার যাবতীয় প্রয়োজন আল্লাহর কাছে পেশ করার আহ্বান করেন।
হাদিসে এসেছে, ‘রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন শাবান মাসের অর্ধেকের রজনী আসে, তখন তোমরা রাতে নামাজ পড়ো, দিনেরবেলা রোজা রাখো। নিশ্চয় আল্লাহ এ রাতে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর আসমানে এসে বলেন, আমার কাছে কোনো গুনাহ ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিকপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেব। কোনো বিপদগ্রস্ত মুক্তি পেতে চায় কি? আমি তাকে মুক্তি দেব। আছে কী এমন, আছে কি তেমন? এমন বলতে থাকেন ফজর পর্যন্ত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৮৮)
আরও পড়ুন : শবে বরাতের ফজিলত ও সওয়াব
আল্লাহ তাআলা শবেরাতে অসংখ্য বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। উদাহরণ হিসেবে মুহাম্মদ (সা.) বকরির পশমের চেয়ে বেশি বান্দাকে এই রাতে ক্ষমা করার কথা বলেছেন। হাদিসে বিধৃত হয়েছে, হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একরাতে রাসুল (সা.)-কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে তাকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, কী ব্যাপার আয়েশা? তোমার কি মনে হয়, আল্লাহ এবং তার রাসুল তোমার ওপর কোনো অবিচার করবেন? আয়েশা (রা.) বললেন, আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। রাসুল (সা.) তখন বললেন, যখন শাবান মাসের অর্ধেকের রাত আসে, আল্লাহ পৃথিবীর আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশিসংখ্যক বান্দাদের ক্ষমা করে দেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৭৩৯)
পাঁচ. শাবান মাসের রোজা কয়টি?
কোনো ব্যক্তি যদি অসুবিধা কিংবা প্রয়োজনবশত শাবান মাসের রোজা রাখতে না পারে, তাহলে সে রমজান মাসের পর রোজা রাখবে। তবে শাবান মাসের রোজা পরবর্তী সময়ে পালন করা ফরজ কিংবা ওয়াজিব নয়। সাহাবি ইমরান ইবনে হোসাইন থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এ মাসের মধ্যভাগে কিছুদিন রোজা রেখেছিলে? সে বলল, না। রাসুল (সা.) বললেন, তুমি তার পরে রমজানের রোজা শেষ করে দুদিন রোজা রাখবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৪২)
রমজান মাস শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে থেকে রোজা রাখার প্রয়োজন নেই। এক হাদিসে মাসের অর্ধেক হলেই রোজা না রাখার কথা বর্ণিত হয়েছে। আরেক হাদিসে দুদিন আগে না রাখার কথা পাওয়া যায়। সেদিনগুলোয় রমজানের রোজার প্রস্তুতি নেবে। তবে কোনো ব্যক্তি যদি সপ্তাহের সুন্নত রোজা (প্রতি বৃহস্পতি ও সোমবার) কিংবা দাউদ (আ.)-এর মতো রোজা (এক দিন রোজা রাখা ও পরদিন না রাখা) পালনের অভ্যাস থাকে, তাহলে সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারবে। প্রয়োজনে শেষ দিনও রোজা রাখতে পারবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘শাবান মাসের অর্ধেক অতিবাহিত হলে তোমরা রোজা রাখবে না।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৩৭)
আরেক হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা রমজানের এক দিন অথবা দুদিন আগে রোজা রাখবে না। অবশ্য কেউ প্রতি মাসে ওই তারিখে রোজা পালনে অভ্যস্ত হলে, সে রাখতে পারবে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৩৩৫)