কর্মী অভিবাসন ও ইমরান আহমদ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়। বিদেশে কর্মসংস্থান এবং অভিবাসী কর্মী ও পরিবারের কল্যাণ নিশ্চিতের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সৈনিক মন্ত্রী ইমরান আহমদের নেতৃত্বে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কাজ করছে। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি গ্রাম পর্যায়ে অভিবাসন সম্পর্কে জনগণকে সচেতনের কাজ শুরু করেন।
জেলায় জনশক্তি অফিস শক্তিশালীকরণ এবং জেলায় জেলায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করছেন। একই সঙ্গে বিদেশের বন্ধ শ্রম কর্মসংস্থান চালু করা, বিদ্যমান কর্মসংস্থান সুদৃঢ় করা এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান চালু করার জন্য নিজেই সরাসরি বিভিন্ন দেশে গিয়ে সরকারের সাথে আলোচনা করেন।
বিজ্ঞাপন
অভিবাসী পরিবারের কল্যাণের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের আওতায় তিনি বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। করোনা মহামারির প্রেক্ষিতে প্রণোদনা দেওয়া, বিমানবন্দরে কোভিড টেস্ট ও বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেন। মন্ত্রী নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। ইতোমধ্যে আরব আমিরাত ও গ্রিসে কর্মসংস্থানের চুক্তি সম্পন্ন করেছেন। দীর্ঘদিনের অচলায়তনে থাকা মালয়েশিয়ার সঙ্গেও সম্পাদন করলেন কর্মসংস্থান চুক্তি।
মালয়েশিয়ার বিএন সরকারের রেখে যাওয়া কর্মী নিয়োগের পদ্ধতি সিন্ডিকেট, অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় ও দুর্নীতির অভিযোগে বাতিল করে পাকাতান হারাপানের ডা. মাহাথির সরকার। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। থমকে যায় অভিবাসন প্রত্যাশী যুবকের স্বপ্ন।
তাৎক্ষণিক মন্ত্রী ইমরান আহমদ প্রথম মালয়েশিয়া সফর করে মানব সম্পদমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও ড. আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ পুনরায় শুরু করার অনুরোধ করেন। তিনি তৎকালীন সরকারকে আশ্বস্ত করেন যে, আগের মতো সে রকম কোনো সিন্ডিকেট হতে দেবেন না। এমন প্রত্যয় নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ইমরান আহমদ।
তিনি বাংলাদেশ রিক্রুটিং এজেন্টের পারফরমেন্স ও সততার ওপর ভিত্তি করে গ্রেডিং করেন এবং ভালো গ্রেড প্রাপ্তরা সুযোগ পাবে বলে আশ্বস্ত করেন। বঞ্চিতরা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের হাইকোর্টে মামলা করে। অপর দিকে রিক্রুটিং এজেন্টগুলো বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় নানান তৎপরতার খবর ছড়িয়ে পরে। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ পক্ষে মালয়েশিয়ার সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করে, পত্র চালাচালি করে। এর মধ্যেই দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সকল নিয়ম কানুন ভঙ্গ করে বায়রা মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সরাসরি পত্র লিখলে প্রচেষ্টা হোঁচট খায় এবং মন্ত্রী বিপাকে পরেন। তবে তার সততা ও আন্তরিকতা দিয়ে সে পরিস্থিতি সামলে উঠেন।
মালয়েশিয়ার সরকার কর্মী নিয়োগের অনুমতি দিলে তৎকালীন মানব সম্পদমন্ত্রী এম কুলাসেগারান চুক্তির জন্য তার টিম নিয়ে ঢাকায় উপস্থিত হন। কিন্তু মালয়েশিয়া সরকার পদত্যাগ করায় কোনো বৈঠক ছাড়াই ফেরত যায় মালয়েশিয়া টিম। আবারো শুরু হয় অনিশ্চয়তা। মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরার জন্য সাধারণ ক্ষমা ব্যাক ফর গুড কর্মসূচি ঘোষণা করলে বাংলাদেশি কর্মীদের দেশে ফেরা শুরু হয়, তাদের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য বিশেষ বাস বরাদ্দ করেন। তিনি মালয়েশিয়ায় আসেন নতুন মানব সম্পদমন্ত্রী এম সারাভানানের সঙ্গে বৈঠক করেন।
আসে মহামারি করোনাভাইরাস। থমকে যায় স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা, বন্ধ হয় কাজ কর্ম, আয় রোজগার না থাকায় চরম অনিশ্চয়তায় জীবন কাটে প্রবাসী কর্মীদের। তাদের জন্য বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করেন যা দূতাবাসের মাধ্যমে প্রকৃত চাহিদাসম্পন্নদের নিকট বিতরণ করা হয়। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রবাসী কমিউনিটিরাও সাহায্যের হাত প্রসারিত করেন। দু’দেশের মধ্যে ফ্লাইট বন্ধ, বাংলাদেশের মানুষের মালয়েশিয়ায় প্রবেশ বন্ধ ইত্যাদি অবস্থা ক্রমশ হতাশা বাড়িয়ে দেয়। এমন অবস্থার মধ্যেই মালয়েশিয়ার মানব সম্পদমন্ত্রী দাতুক শ্রী এম সারাভানানের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেন।
এর মধ্যে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনার পরিবর্তন হলেন। করোনাভাইরাসের মধ্যেও দু’দেশের মধ্যে ভার্চুয়ালি দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে মালয়েশিয়া সরকার বৈধতাকরণ রিক্যালিব্রেশন কর্মসূচি শুরু করে। বাংলাদেশি কর্মীদের ভালো নিয়োগকর্তা এবং নিয়োগকর্তাদের কর্মী খুঁজে পাওয়ার জন্য দূতাবাসের উদ্যোগে একটি অনলাইন প্লাটফরমের উদ্বোধন করেন মন্ত্রী ইমরান আহমদ।
জানা যায়, করোনা মহামারির বৃদ্ধি পেলে শ্রম উইংয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মনোবল ধরে রেখে প্রবাসীদের জন্য কাজ করতে নিয়মিত ভার্চুয়ালি সভা করে উৎসাহ দিয়েছেন। তাদের পরিবারের সবার খবর নিয়েছেন, বারবার নির্বাচিত হওয়া এমপি ইমরান আহমদ।
আলোচনার মধ্যেই জিটুজি প্লাস সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসতে থাকে। সামান্য কিছু সংশোধন এবং সংযোজন, বিয়োজন করে সেই চুক্তিকেই পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয় উভয় পক্ষ। কিন্তু কতটি বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী প্রেরণ করবে এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আলোচনা আর বেশি দূর এগোয়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পক্ষ প্রেস ব্রিফ করে। যে পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ সে রকম কোনো পদ্ধতি হবে, না কি সকলের জন্য উন্মুক্ত হবে এমন প্রশ্ন আসে বিভিন্ন মহল থেকে। সিন্ডিকেটের সময় ১০টি রিক্রুটিং এজেন্টের নাম উচ্চারিত হলেও বিএমইটির তথ্যানুযায়ী, তিন শতাধিক বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ করেছে।
মন্ত্রী ইমরান আহমদ মালয়েশিয়ার মানব সম্পদমন্ত্রীকে সাফ জানিয়ে দেন যোগ্য রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা দেওয়া হবে বাকিটা মালয়েশিয়া সিদ্ধান্ত নিবে। তিনি বরাবরই বলে এসেছেন এমন কোনো সিন্ডিকেট হতে দেবেন না যা ক্ষতিকর।
উল্লেখ্য, গত ১০টি বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিকে বেছে নিয়েছিল মালয়েশিয়া। বাংলাদেশ অসম্মত হলেও একপর্যায়ে মেনে নেয়। এরমধ্যে মালয়েশিয়া মানব সম্পদ মন্ত্রণালয় পূর্বের সকল আলোচনা ও সিদ্ধান্তকে এক পাশে রেখে একেবারে নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেয়। এমন সিদ্ধান্তে বিস্মিত হলেও মন্ত্রী ইমরান আহমদ এই প্রচেষ্টাকেও স্বাগত জানান।
এ নিয়ে দু দেশের মন্ত্রণালয় কাজ করে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের জন্য মন্ত্রী ইমরান আহমেদ মালয়েশিয়ার মানব সম্পদমন্ত্রীর আমন্ত্রণ পান। কিন্তু সে সময় সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়োগে মানব সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব মালয়েশিয়ার কেবিনেট অনুমোদন করে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে মানব সম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান মন্ত্রী ইমরান আহমদকে আমন্ত্রণ জানান সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করতে।
সমঝোতা স্মারকের ফলে উভয় দেশের মধ্যে দর কষাকষির ক্ষেত্র তৈরি হলো। এখানেই থামবেন না মন্ত্রী ইমরান আহমদ, তিনি সুন্দর ও যৌক্তিক রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কর্মী প্রেরণের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এজন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
এদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রমবাজার নিয়ে সই হওয়া সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) শিগগির অনুমোদনের জন্য মালয়েশিয়ার মন্ত্রিসভায় উঠবে বলে জানিয়েছেন দেশটির মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান। ১৯ ডিসেম্বর কুয়ালালামপুরে দেশটির মানব সম্পদমন্ত্রী সারাভানান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদের সঙ্গে স্মারকে সই করার পর এক বিবৃতিতে এসব কথা জানান।
স্মারকে সই হওয়ার পর বিবৃতিতে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদের সঙ্গে কুয়ালামপুরে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। সমঝোতা স্মারকটি অবিলম্বে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপন করা হবে। এটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হলে কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে মালয়েশিয়ার আগের সমঝোতা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। নতুন এ সমঝোতা স্মারক আগামী পাঁচ বছর কার্যকর থাকবে। এটির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে।
এই চুক্তিতে থাকছে উভয় দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোও। উভয় দেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডব্লিউজি) চুক্তির বিষয়গুলো দেখভাল করবে।
২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের তিন লাখ ২৬ হাজার ৬৬৯ জন কর্মী কাজ করছেন। তাদের মধ্যে উৎপাদনখাতে এক লাখ ১১ হাজার ৬৯৪ জন এবং নির্মাণখাতে এক লাখ ৩৬ হাজার ৮৯৭ জন রয়েছেন।
এই চুক্তির ফলে যে বিদেশি কর্মীদের জরুরি প্রয়োজনে বিশেষ করে গৃহকর্মী, বাগান, কৃষি, উৎপাদন, পরিষেবা, খনি ও খনন এবং নির্মাণখাতের জন্য ৩২ হাজার কর্মীর চাহিদা দ্রুতই পূরণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব আগেই মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী মালয়েশিয়া তাদের অ্যাক্ট ৪৪৬ অনুযায়ী, কর্মীদের আবাসনসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা একটি মানে উন্নীত করবে। মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশসহ বিদেশি কর্মীদের সবকিছু তদারকি করবে।
সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশি কর্মীদের মালয়েশিয়া প্রান্তের সব খরচ নিয়োগকর্তা বহন করবেন। যেমন- রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি নিয়োগ, মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়া, তাদের আবাসন, কর্মে নিয়োজিত করা এবং কর্মীর নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর খরচ বহন করবেন।
এছাড়া নিয়োগকর্তা নিজ খরচে মালয়েশিয়ান রিক্রুটিং এজেন্ট নিযুক্ত করতে পারবেন। মালয়েশিয়ায় আসার পর বাংলাদেশি কর্মীর ইমিগ্রেশন ফি, ভিসা ফি, স্বাস্থ্য পরীক্ষার খরচ, ইন্স্যুরেন্স সংক্রান্ত খরচ, করোনা পরীক্ষার খরচ, কোয়ারেন্টাইন–সংক্রান্ত খরচসহ সব ব্যয় মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা বা কোম্পানি বহন করবে। নিয়োগকর্তা কর্মীর মানসম্মত আবাসন, বিমা, চিকিৎসা ও কল্যাণ নিশ্চিত করবেন।
এছাড়া মালয়েশিয়ার এমপ্লয়িজ সোশ্যাল সিকিউরিটি এক্ট ১৯৬৯ এর আওতায় কর্মকালীন দুর্ঘটনা বা কাজের কারণে শারীরিক সমস্যা হলে চিকিৎসা, পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণ পাবেন প্রত্যেক কর্মী। ফলে ফ্রি চিকিৎসা সুবিধা, অস্থায়ী অক্ষমতার সুবিধা, স্থায়ী অক্ষমতার সুবিধা, নিরবচ্ছিন্ন উপস্থিতি ভাতা, ডিপেন্ডেন্ট বেনিফিট, পুনর্বাসন সুবিধাসহ মালয়েশিয়ার আইনানুযায়ী সুবিধা পাবেন তারা।
ওএফ