করোনার উৎস সন্ধানের রাজনীতি বন্ধ হওয়া দরকার
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে চীন। দুই দেশের মধ্যে প্রথম বাণিজ্য নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হলেও এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা হচ্ছে। তাইওয়ান, দক্ষিণ চীন সাগর ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগসহ বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের টানাপড়েন ক্রমেই বাড়ছে। দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে শতাব্দীর ‘সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক পরীক্ষা’ হিসেবে অভিহিত করেছে বাইডেন প্রশাসন।
চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়ে মহামারি করোনাভাইরাস। এরপর থেকে সবচেয়ে গুরুতর সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হলো এর উৎপত্তি নিয়ে। সাধারণত, এ ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের সমাধান করতে অনেক বছর লেগে যায়। তবে, কিছু পশ্চিমা রাজনীতিবিদ করোনাভাইরাসের উৎপত্তি সম্পর্কে চীনকে দায়ী করতে চাওয়ায় সত্য উন্মোচন কঠিন হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মহামারির উৎপত্তি নিয়ে সন্দেহ করায় আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
গত ২৬ মে হোয়াইট হাউসের দেওয়া বিবৃতি অনুসারে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গোয়েন্দা সংস্থাকে করোনার উৎপত্তি অনুসন্ধানের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দেন। ১০ জুন জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের আগে বাইডেন ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ফেজ-২ অরিজিন ট্রেসিং স্টাডি প্ল্যানকে স্বাগত জানাবে। ১৪ ও ১৫ জুন ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র ইইউর সঙ্গে একটি যৌথ বিবৃতিতে বলেছিল যে, তারা করোনাভাইরাসের উৎস নিয়ে ডব্লিউএইচওর পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপকে সমর্থন করবে।
এরপরে, ডব্লিউএইচও তার সদস্য দেশগুলোকে করোনার ট্রেসিবিলিটি ওয়ার্ক প্ল্যানের দ্বিতীয় ধাপ সম্পর্কে অবহিত করে। ১৬ জুলাই ঘোষণা করে ট্রেসিবিলিটি তদন্তের দ্বিতীয় পর্যায়ে চীনে আরও গবেষণা ও পরীক্ষাগার তদন্ত করা উচিত। অথচ, এই বছর ৩০ মার্চ করোনার উৎপত্তি সন্ধানে চীন ও ডব্লিউএইচওর যৌথ গবেষণা দলের ট্রেসিবিলিটি তদন্তের প্রথম পর্যায়ের প্রতিবেদনটি ডব্লিউএইচও কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়।
যৌথ গবেষণা দলটি এই উপসংহারে পৌঁছে যে, চীনা ল্যাব থেকে ল্যাবরেটরি লিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। গবেষকদের উচিত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সম্ভাব্য প্রাথমিক ক্ষেত্রে খোঁজ রাখা। কোল্ড চেইন ও হিমায়িত খাদ্য সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা করা। এটি একটি বৈজ্ঞানিক ও প্রামাণিক প্রতিবেদন যা ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী ভাইরাসের উৎপত্তি সন্ধানের প্রচেষ্টার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
করোনার প্রাদুর্ভাবের একেবারে শুরুর দিকে চীন ও ডব্লিউএইচও কর্তৃক জারি করা সতর্কতা তৎকালীন মার্কিন সরকার অনেকটা উপেক্ষা করেছিল। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রে যখন মহামারি ছড়িয়ে পড়ে, তখন মার্কিন নেতারা ভাইরাসটিকে ‘চীনা ভাইরাস’ বা ‘উহান ভাইরাস’ বলে উল্লেখ করেন। যা মহামারি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে পরস্পর বিরোধী মনোভাব প্রকাশ পায়। যদিও ডব্লিউএইচও কর্তৃক অদৃশ্য ভাইরাসটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কোভিড-১৯’।
গতবছর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের উহান শহরে অবস্থিত একটি ল্যাব থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে দাবি করে ‘ল্যাবরেটরি লিক থিওরি’ প্রস্তাব করেছিলেন। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ও অন্যান্য মার্কিন রাজনীতিবিদরা ল্যাবরেটরি লিক থিওরিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বিভিন্ন সময় এর পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন। তারপর জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের চীন নীতে ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশলই বজায় রাখেন। উন্নত চিকিৎসা ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ও মৃত্যুর দেশ হয়ে উঠেছে।
করোনার পুনরাবৃত্তি ও এর নেতিবাচক প্রভাবের মুখে, বৈশ্বিক মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর ও উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কাছে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যাশা অনেক বেশি। দুর্ভাগ্যবশত, ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের কিছু রাজনীতিবিদরা ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে রাজনীতিকরণ এবং চীনকে দোষারোপ অব্যাহত রাখার ফলে সাধারণ মানুষসহ আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ ও আতঙ্ক ভর করেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল থেকে সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের করোনার উৎপত্তিস্থল নিয়ে রাজনীতির ব্যাপারে আপত্তি জানায়। তারা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, মহামারীকে নিয়ে বিতর্ক, লেবেলিং ও রাজনীতিকরণ না করতে আহ্বান জানায়। তারা জোর দিয়ে বলেন, ভাইরাস মানবজাতির দুশমন। করোনার উৎপত্তি ও শনাক্তকরণ নিয়ে গবেষণা বৈজ্ঞানিক ও বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতিতে পরিচালিত হওয়া উচিত।
ব্রাজিলিয়ান ইনস্টিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল রিসার্চের গবেষক মার্গারেট ডালকম বলেছেন, করোনার উৎপত্তি নিয়ে রাজনীতি করা বৈজ্ঞানিক নয় এবং উৎসের জন্যও সহায়ক নয়। এটি আসলে বিজ্ঞানের চেয়ে ষড়যন্ত্রের মতো। রাজনীতি রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি করবে। এটি জন মনে নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করে।
যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফ্রি স্যাক্স ২৬ জুলাই তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, করোনার উৎপত্তি জানা কোনো ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা নয়।
গত ১৩ আগস্ট কূটনীতিকদের নিয়ে করোনার উৎপত্তি সন্ধানের বিষয়ে ব্রিফিংয়ে চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মা ঝাউশু উল্লেখ করেছিলেন, সম্প্রতি ৭০টি দেশ ডব্লিউএইচও-চীন যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে। ডব্লিউএইচও মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দিয়ে উৎস সন্ধান নিয়ে রাজনীতি করার বিরোধিতা করেছেন। ৩০টিরও বেশি দেশ ডব্লিউএইচও সেক্রেটারিয়েটদের ট্রেসিবিলিটি তদন্তের দ্বিতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিরোধিতা বা আপত্তি জানিয়েছে। ১০০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চল থেকে ৩০০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল, সামাজিক গোষ্ঠী ও থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ডব্লিউএইচও সেক্রেটারিয়েটের প্রতি একটি যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছে।
তারা বিবৃতিতে ডব্লিউএইচওকে করোনার উৎস শনাক্তকরণ গবেষণাটি নিয়ে রাজনীতি না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। তাছাড়া পেশাজীবী, গবেষক, গোষ্ঠী ও বিভিন্ন দেশের মিডিয়া করোনার উৎস নিয়ে রাজনীতি না করার কথা জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ফোর্ট ডেট্রিক জৈবিক পরীক্ষাগার নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ রয়েছে। যা ২০১৯ সালের শেষের দিকে করোনা মহামারি শুরুর আগেই হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জনস্বাস্থ্য সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) আদেশ জারি করলে ফোর্ট ডেট্রিক জৈব পরীক্ষাগারটি বন্ধ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট মার্কিন বিভাগ জাতীয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে তথ্য প্রকাশ করতে বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
স্পষ্টতই, যদি নিরপেক্ষভাবে করোনার উৎস শনাক্তকরণকে কার্যকরভাবে প্রচার করা হয়, তবে ফোর্ট ডেট্রিকের জৈবিক পরীক্ষাগারকে আন্তর্জাতিক তদন্তের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে মনে করে আন্তর্জাতিক মহলের অনেকেই। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত এই ব্যাপারে নীরব রয়েছে। সম্প্রতি চীনা নেটিজেনরা একটি বৃহৎ আকারের যৌথ স্বাক্ষর অভিযান শুরু করেছে এবং ডব্লিউএইচওকে ফোর্ট ডেট্রিক জৈবিক পরীক্ষাগার পরিদর্শন করার আহ্বান জানিয়েছে। যৌথ স্বাক্ষর অভিযানে ২৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেছে।
করোনার উৎপত্তি শনাক্তকরণে যুক্তরাষ্ট্র চীন ওপর ‘আনুমানিক অপরাধের’ দায় চাপাতে চায়। যার পেছনে ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ডব্লিউএইচও জয়েন্ট এক্সপার্ট গ্রুপের সদস্য, অস্ট্রেলিয়ান ইমিউনোলজিস্ট ও এপিডেমিওলজিস্ট ডমিনিক ড্রয়ার বলেছেন, চীনা ল্যাবরেটরি থেকে ভাইরাস ছড়ানোর কোনো প্রমাণ নেই। করোনার উৎপত্তি বের করার কাজটি অত্যন্ত জটিল। এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, চীন তথ্য গোপন করেছে। দেশগুলোর একে অপরকে সহযোগিতা করা উচিত। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে করোনার উৎস শনাক্তকরণের জন্য গবেষণা করা উচিত।
পরিশেষে বলা যায়, করোনার উৎপত্তি সন্ধানের জন্য বৈজ্ঞানিক প্রমাণ প্রয়োজন। ভাইরাসের উৎস সন্ধান শুধুমাত্র একটি বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা। করোনা কোথা থেকে এসেছে তা বের করার জন্য বিজ্ঞানীদের সময় দিতে হবে। ল্যাবরেটরি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল বা সংক্রামিত প্রাণীর মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল কি-না তা নির্ধারণ করতে সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে রাজনীতি করলে বড় ক্ষতি আমাদেরই হবে। অনেক অজানা বিষয় সমাধানের পর যখন বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল বেরিয়ে আসবে তখন আমরা সত্যের কাছাকাছি চলে যাব। সব দল তথ্য ও বিজ্ঞানের প্রতি সম্মান দেখালেই সমাধান বেরিয়ে আসবে।
লেখক : চীনের চিয়াংশি ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিক্সের একজন ডক্টরাল ফেলো ও প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক।