মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ : নতুন ইস্যুতে প্রস্তুতি
করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বে জীবন, জীবিকা ও রাষ্ট্রপরিচালনাসহ সব ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিশ্চয়তা লক্ষণীয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মানব পাচার ও জোরপূর্বক শ্রম আদায়ের প্রসঙ্গ। এসব অভিযোগে সম্প্রতি আমেরিকা, ইউরোপ ও ইউকে মালয়েশিয়া থেকে পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
শ্রম প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্যও ভাবনার। মানব পাচার ও জোরপূর্বক শ্রম আদায় বা আধুনিক দাসত্বের ভিকটিম ইস্যুতে এসেছে বাংলাদেশী কর্মীদের নাম। এ ইস্যুতে মালয়েশিয়া ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। এতে উঠে এসেছে বাংলাদেশ পক্ষের বিষয়াদি।
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টে বারবার বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার করে মালয়েশিয়ায় আনা ও জোর করে শ্রমে নিয়োজিত করার অভিযোগ উঠে এসেছে। ২০০৬/০৭ সালে মালয়েশিয়ায় অতিরিক্ত বাংলাদেশী কর্মী এনে কাজ, আশ্রয়, খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাহীন অবস্থায় মানবিক বিপর্যয় হয়েছিল। এ জন্য মালয়েশিয়াকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়োগ বন্ধ করে।
২০১২ সালে জি টু জি পদ্ধতিতে শুধু প্ল্যান্টেশন সেক্টরে ৪০-৫০ হাজার টাকায় ১০ হাজারের মতো কর্মী বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় প্রেরণ করে। এটি অভিবাসনের ভালো দৃষ্টান্ত হলেও অনুসরণ করা হয়নি। এরমধ্যে ২০১৫ সালে মানব পাচারের আন্দামান ট্রাজেডি উন্মোচিত হয়েছে।
পরবর্তীতে ২০১৬ সালে বাংলাদেশী কর্মী রিক্রুটমেন্ট, এমপ্লয়মেন্ট ও রিপাট্রিয়েশনের জন্য পাঁচ বছর মেয়াদী জিটুজি প্লাস চুক্তি করে বাংলাদেশ প্রান্তে রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিকে জড়িত করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ১১শ এর অধিক বাংলাদেশী রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা মালয়েশিয়া সরকারের নিকট হস্তান্তর করে।
চুক্তি অনুযায়ী মালয়েশিয়া সরকার অনলাইন সিস্টেমে ১১শ তালিকা থেকে অটোভাবে বাংলাদেশ রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাই করে ডিমান্ড লেটার ও পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ইস্যু করে। কিন্তু নিয়োগ শুরুর প্রাক্কালে মালয়েশিয়া সরকার ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাই করে বাংলাদেশ সরকারের সম্মতির জন্য অনুরোধ পত্র দেয়। এর প্রেক্ষিতে কর্মী প্রেরণের স্বার্থে বাংলাদেশ সরকার মালয়েশিয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়। ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির অধীনে কনসোর্টিয়াম করে সব রিক্রুটিং এজেন্সি কাজ করার সুযোগ দেয়। এই কনসোর্টিয়াম কাজ করেনি।
তবে বিএমইটি সূত্র অনুযায়ী, ১০টির বাইরে আড়াই শতাধিক রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ করেছে। যদিও সেই ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে সিন্ডিকেট আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের হাইকোর্টে রিট করা হয়।
একইভাবে কর্মী নিয়োগের খরচ উভয় দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক নির্ধারিত পরিমাণ অনুসরণ করেনি। বরং ক্রমশ বৃদ্ধি করে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এক লাখ ৬৫ হাজার টাকায় স্থির করে। মালয়েশিয়ায় আগত কর্মীদের মাঝে জরিপ চালিয়ে বিভিন্ন এনজিও এবং পণ্য গ্রহণকারী দেশের সংস্থা অডিট করে কর্মীদের বাড়ি থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মে নিয়োজন পর্যন্ত প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য খরচের চিত্র উঠে আসে। এজেন্সির ফিসহ সব অর্থই কর্মীকে দিতে হয়েছে।
এই অর্থ দিতে গিয়ে জমি, গরু ও সোনা বিক্রি, ঋণ এবং বিয়ে করে যৌতুক নেওয়ার তথ্য উঠে আসে। অধিকন্তু নেপাল থেকে ৫০-৬০ হাজার বাংলাদেশি টাকায় মালয়েশিয়ায় কর্মী আসার তুলনামূলক তথ্য পাওয়া যায়। কর্মীরা বুঝতে পারে এত খরচের অর্থ মাত্র তিন বছরে তোলা সম্ভব নয়। দেশে কাজ ও বেতন সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে প্রলুব্ধ করা হয়েছে।
অতিরিক্ত খরচ করে আসা কর্মীকে অমানবিক শ্রম দিতে ও অবস্থান করতে বাধ্য করা হচ্ছে, নানান হুমকি মেনে নিচ্ছে এবং অবৈধ হয়ে আইন কানুনের ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে এমন প্রমাণ সংগ্রহ করে মালয়েশিয়ার এনজিও এবং বিদেশি নিরীক্ষক। এমন রিপোর্ট হলে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ইউকে এসব কর্মীর শ্রমে উৎপাদিত পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
তখন নিয়োগকারী কোম্পানিগুলো কর্মীর খরচের অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেয়, সঠিক আবাসন তথা সুন্দর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা বেড়াজাল থেকে বের হওয়ার প্রচেষ্টা নিয়েছে। এটি শুধু উৎপাদক কোম্পানি নয়, মানবপাচার ও দাসত্ব শ্রমের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক সূচকের টায়ার টু এর সর্বনিম্ন ধাপে অবনমন করে মালয়েশিয়ার।
এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ প্রান্তে না ঘটলে মালয়েশিয়ায় ভালোভাবে কাজ করার কোনো সমস্যা হত না। যেমনটা নেপালের ক্ষেত্রে হচ্ছে না বলে অনেক কর্মী জানিয়েছেন।
তবে মাহাথির সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে এবং ২০১৬ সালে সম্পাদিত পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তির কার্যকারিতা ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে উভয় দেশের মধ্যে চারটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা হয়েছে। প্রতিবার বৈঠকের আগে রব ওঠে আবারও সিন্ডিকেট করা হচ্ছে কিনা, আবারও অধিক খরচ হবে কিনা? এবার জি-টু-জি প্লাস পদ্ধতিতে নিয়োগ করা কর্মীরা কেউই কর্মহীন নেই। এটি পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো দৃষ্টান্ত হিসেবে নিয়েছে। কিন্তু শঙ্কা আছে বেশি খরচ নিয়ে, একইভাবে শঙ্কিত মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা।
তারা আশঙ্কা করছে, সব খরচ যদি দেয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে কর্মীর অপ্রকাশ্য খরচ যে হবে না তার গ্যারান্টি কী? বাংলাদেশ থেকে আগমনের পূর্বে দায়িত্বপ্রাপ্ত রিক্রুটিং এজেন্সি কাজ, বেতন ও আবাসন সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা দেবে কিনা?
এমন বিষয় সামনে এসেছে। অর্থাৎ খরচ এবং ধারণা প্রদান এই দুটি বিষয় বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করছে। আগের দৃষ্টান্ত অনুযায়ী নিয়োগকর্তারা ক্ষতির মধ্যে না পড়তে হিসেব করছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মিডিয়া থেকে জানা গেছে। এই দুটি ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে।
বাংলাদেশ সেইফ, অর্ডারলি ও যৌক্তিক মাইগ্রেশনের ক্ষেত্রে বরাবরই সোচ্চার। কিন্তু এসব ঘটনা সেই সোচ্চারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ বিষয়ে স্পষ্ট দৃষ্টান্ত রেখে আগামীর পথ সুগম করবে মন্ত্রণালয় এমনটি আশা করে অভিবাসী কর্মীরা।
মাইগ্রেশন ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে রিক্রুটিং এজেন্সি আন্তরিক ও সবধরনের সহযোগিতা করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু একই সঙ্গে তারা মন্ত্রণালয়ের কাছে যৌক্তিক আচরণ আশা করেছে কয়েকজন রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে।
মাইগ্রেশন বিষয়ক সাংবাদিক মেরাজ হোসেন গাজী বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় যেমন-তেমনভাবে কর্মী পাঠানোর ফলে যে জটিলতা দেখা দিয়েছে, প্রবাসীর অকল্যাণ হচ্ছে এবং দেশের ইমেজের ক্ষতি হচ্ছে সেগুলো এখন স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে এসেছে। এক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী রিক্রুটিং এজেন্সির অনেক দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাই সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রণালয়কে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনোর কোনো বিকল্প নেই।’
সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় গেলে শুনি যে নেপালের কর্মীরা অল্প খরচে যায়, আর আমাদের অনেক বেশি খরচ লাগে। বিষয়টি পাত্তা না দিতে দিতে এখন উভয় দেশের জন্য সমস্যা হয়েছে। তাছাড়া নানান ধরনের সাফারিংস যে বিভিন্ন গবেষণা বা অডিটে উঠে এসেছে সেগুলোকে এখন গুরুত্ব দেওয়া উচিত হবে। এতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।’
সিনিয়র সাংবাদিক কাজী কেরামত উল্লাহ বিপ্লব বলেন, ‘মাইগ্রেশন ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অনেক পরে নেপাল এসে সুন্দর ব্যবস্থাপনায় এখন বাংলাদেশের থেকে অগ্রগামী হয়েছে। এমনকি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশকে হটিয়ে দ্বিতীয় স্থানে অর্থাৎ বাংলাদেশের স্থান দখল করেছে। অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো দেশে প্রবেশ করেছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ পুরাতন হলেও নানান অব্যবস্থাপনায় ক্রমশ আস্থাহীনতায় পড়ে গেছে। কাগজ কলমে সোচ্চার হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। এর তুলনায় ভারত বা ফিলিপাইনের আশপাশেও নেই। দেশের স্বার্থেই সুন্দর সহজ ও স্বচ্ছ মাইগ্রেশন ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই।’
প্রবাসী কল্যাণ সচিব ড. আহমেদ মনিরুস সালেহীন বলেন, ‘বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকার কর্মীদের কল্যাণে অনেক আন্তরিক। মাইগ্রেশনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক থেকে ওঠা অভিযোগ বা পরামর্শগুলো মন্ত্রণালয় গুরুত্ব দিয়ে দেখছে, স্ট্যান্ডার্ড প্রক্রিয়া ফলো করতেই হবে। করোনা পরবর্তী বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ নিতে বিভিন্ন দেশের পলিসি বা প্ল্যানের প্রতি আমাদের নজর আছে। করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন দেশ ও মিশনের সঙ্গে নিয়মিত সভা, তথ্য সংগ্রহ, বায়রার মতামত ও মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণে কাজ করছি। মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তাদের নিশ্চয়তা দিতে পারি আর উদ্বিগ্ন হতে হবে না। আমরা প্রস্তুত আছি নিয়োগ কর্তার চাহিদা পূরণ করতে।’
ওএফ