ব্রিটিশ-বাংলাদেশি পেশাজীবীদের উদ্যোগে ‘দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি : জাতি গঠনে তারা কীভাবে ভূমিকা পালন করতে পারেন’ শীর্ষক এক গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বুধবার (৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় লন্ডন স্কুল অব কমার্স অ্যান্ড আইটির মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেন, বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে প্রবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দূতাবাস ও হাইকমিশন ঘেরাও করেছেন, সভা-সমাবেশ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে বিক্ষোভ করতে গিয়ে অর্ধশত প্রবাসী জেল খেটেছেন। সর্বশেষে প্রবাসীরা ৫ আগস্টের আগে মাসব্যাপী রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে সরকারের টনক নাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

তারা বলেন, সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি জানিয়েছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় বৈদেশিক রিজার্ভে হাত না দিয়েই বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে। সুতরাং দেড় কোটির বেশি প্রবাসীকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। তাই দেশ পরিচালনায় উপদেষ্টা পরিষদে অন্তত ১০ শতাংশ প্রবাসী বাংলাদেশি নেওয়া অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত।

বক্তারা আরও বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন আছে। যেকোনো উপায়ে এই সরকারকে সফল হতেই হবে। সরকার ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে। সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৫৩ বছর পর দেশ গড়ার এক সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ থেকে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ বাংলাদেশি যারা প্রবাসে থাকেন তাদের বঞ্চিত করলে বরং দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পৃথিবীর প্রায় ১৫টি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ আছে যাদের একেকটির মোট জনসংখ্যা দেড় কোটি হবে না। সুতরাং এত বিপুল সংখ্যক প্রবাসীকে অবহেলা করে রাষ্ট্রের টেকসই সংস্কার বা মেরামত করা সম্ভব নয়। দেড় কোটি প্রবাসীকে সন্তুষ্ট করুন এবং তাদের ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবিগুলো মানুন। তার বিনিময়ে দেখবেন প্রবাসীরা কোটি কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি চাঙা করে দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিনেটর নাসরুল্লাহ খান জুনায়েদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এবং প্রথিতযশা আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার নাজির আহমদের সঞ্চালনায় সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ওলিউল্লাহ নোমান।

এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. হাসানাত হোসেন এমবিই এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আব্দুল কাদের সালেহ।

আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক, ব্যারিস্টার ইকবাল হোসেন, ব্যারিস্টার হামিদুল হক আফিন্দী লিটন, সাবেক সেনা কর্মকর্তা আমিন চৌধূরী, ব্যারিস্টার আলিমুল হক লিটন, ব্যারিস্টার এম ফয়ছল, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম এমাদ, ব্যারিস্টার আলী ইমাম, যুবনেতা নাসির উদ্দিন, গবেষক শরীফুল ইসলাম, মানবাধিকার কর্মী তানভীর হাসান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিলেতের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ আহমদ, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট সাজেদুর রহমান, সমাজকর্মী আমিনুল ইসলাম প্রমুখ।

গোলটেবিল বৈঠক থেকে যেসব দাবি জানানো হয়–

১.  প্রবাসীদের ন্যায়সংগত অধিকার, বিভিন্ন দাবি-দাওয়া, সেবার মান ও অভিযোগ– এসব বিষয়ে সংস্কারের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি জানাচ্ছি।

২. দেড় কোটির বেশি প্রবাসী অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ বাংলাদেশি দেশের বাইরে বসবাস করছেন। তারা বাংলাদেশের নাগরিক। চার লাখ চাকমাদের জন্য প্রতিটি সরকারে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারেও আছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে দেড় কোটি প্রবাসীদের জন্য কোনো সরকারেই প্রবাসী প্রতিনিধি রাখা হয়নি। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে দেড় কোটির বেশি প্রবাসীদের মধ্য থেকে অন্তত দুই জন উপদেষ্টা রাখার দাবি জানাচ্ছি।

৩. দ্বৈত নাগরিকরা বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, এমনকি প্রধান বিচারপতি হতে পারলেও এমপি হওয়ার পথে সাংবিধানিক বাধা ও বৈষম্য রাখার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নাগরিক যারা দ্বৈত-নাগরিকত্ব নিয়েছেন তাদের জন্য সংবিধানের বৈষম্যমূলক ৬৬(২)(গ) অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করার দাবি।

৪. ব্রিটেনে ব্রিটিশ-বাংলাদেশিরা সুপ্রতিষ্ঠিত। এখানে শত শত দক্ষ প্রফেশনাল আছেন যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলছেন। হাজার হাজার অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ও লন্ডন গ্র্যাজুয়েট আছেন যারা বাংলাদেশ পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আধুনিক মালয়েশিয়া নির্মাণে মালয়েশিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মুহাম্মদ ব্রিটেনে এসে ব্রিটিশ-মালয়েশিয়ানদের মধ্যে ট্যালেন্ট হান্ট করতেন। এমনটি করার জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। সুপ্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের বাংলাদেশকে দেওয়ার মতো অনেক কিছু আছে।

৫. ব্রিটেন থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে ভ্যালিড বাংলাদেশি পাসপোর্ট থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ২/৩ বছর আগে। পাওয়ার অব অ্যাটর্নির সঙ্গে ভ্যালিড বাংলাদেশি পাসপোর্টের সম্পর্ক বোধগম্য নয়। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন আজগুবি নিয়ম নেই। এ নিয়ম চালু করার কারণে লাখ লাখ প্রবাসী মারাত্মক ঝামেলায় পড়েছেন। অন্য দেশের প্রবাসীরাও বিড়ম্বনায় পড়েছেন। এ অবস্থায় পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদনে আইডি হিসেবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট অথবা ব্রিটিশ পাসপোর্ট অথবা এনআইডি কার্ড গ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে অতি দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারির জোর দাবি জানাচ্ছি।

৬. বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অথচ যাদের ভোটে এমপি নির্বাচিত হন তাদের সঙ্গে সুযোগ-সুবিধায় বিরাট বৈষম্য রয়েছে। যেমন এমপি হলেই ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি, ঢাকায় রাষ্ট্রীয় জমি বরাদ্দসহ নানা উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। রাষ্ট্রের মালিক তথা ভোটারদের বাসস্থান ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত না হলেও এমপিদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। এটা রাষ্ট্রের নাগরিকদের সঙ্গে বিরাট বৈষম্য তৈরি করে। অথচ সংবিধানে বলা আছে আইনের চোখে সকলেই সমান। অবিলম্বে এসব বৈষম্যমূলক সুযোগ-সুবিধা ও বরাদ্দ বাতিল করতে হবে। পৃথিবীর উন্নত কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের বৈষম্যমূলক সুযোগ-সুবিধা ও বরাদ্দ দেওয়া হয় না এমপিদের। সেখানে স্থানীয় উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে।

এসএসএইচ