বিশ্ব ঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজের অংশ ইংল্যান্ডের ডরসেটের ডারডল ডোর। অসাধারণ একটি ভ্রমণের জায়গা এটি। এখানে ডোর মানে দরজা। এটি ইংল্যান্ডের ডরসেটের লুলওয়ার্থের কাছে জুরাসিক উপকূলে একটি প্রাকৃতিক চুনাপাথরের খিলান।

ডারডল ডোরের চারদিকে উপকূলের সৌন্দর্যের রূপ। খিলানটি একটি সমন্বিত উপকূল রেখায় গঠিত হয়েছে, যেখানে শিলার ব্যান্ডগুলো উপকূলরেখার সমান্তরালে চলে। শিলাস্তরগুলো প্রায় উল্লম্ব এবং শিলার ব্যান্ডগুলো বেশ সরু। মূলত প্রতিরোধী পোর্টল্যান্ড চুনাপাথরের একটি ব্যান্ড উপকূল বরাবর দৌড়েছিল, একই ব্যান্ড যেটি উপকূল বরাবর এক মাইল দূরে লুলওয়ার্থ কোভের সরু প্রবেশপথ তৈরি করে। এর পেছনে রয়েছে ১২০ মিটার (৩৯০ ফুট) দুর্বল, সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাগুলোর ব্যান্ড এবং এর পেছনে রয়েছে একটি শক্তিশালী এবং অনেক মোটা চকের ব্যান্ড, যা পুরবেক পাহাড় গঠন করে। এই খাড়াভাবে নিমজ্জিত শিলাগুলো লুলওয়ার্থ ক্রাম্পলের অংশ, নিজেই বৃহত্তর পুরবেক মনোক্লাইনের অংশ, মধ্য-সেনোজোয়িক সময়ে আল্পস পর্বতমালার দ্বারা উৎপাদিত হয়।

চুনাপাথর এবং চক সোয়ানেজের চেয়ে ডারডল ডোরের কাছাকাছি, ১০ মাইল (১৬ কিলোমিটার) পূর্বে, যেখানে দূরত্ব ২ মাইল (৩ কিলোমিটার) বেশি। উপকূলের এই অংশের চারপাশে, প্রায় সমস্ত চুনাপাথর সমুদ্রের ক্ষয় দ্বারা অপসারণ করা হয়েছে, বাকি অংশটি খিলানসহ ছোট হেডল্যান্ড গঠন করে। চুনাপাথর ব্যান্ডের পশ্চিম প্রান্তে ক্ষয়ের ফলে খিলান তৈরি হয়েছে।

যতদূর জেনেছি, ইউনেস্কোর দলগুলো খিলান এবং সংলগ্ন সমুদ্র সৈকতের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। ১২০ মিটার (৩৯০ ফুট) ইসথমাস, যা চুনাপাথরকে চকের সঙ্গে যুক্ত করে পোর্টল্যান্ড চুনাপাথরের একটি ৫০ মিটার (১৬০ ফুট) ব্যান্ড দিয়ে তৈরি, এটি একটি সংকীর্ণ এবং সংকুচিত ব্যান্ড। ক্রিটেসিয়াস ওয়েল্ডেন কাদামাটি ও বালি, তারপর সবুজ বালি ও বেলেপাথরের সংকীর্ণ ব্যান্ড।

ম্যান ও ওয়ার উপসাগরে ডার্ডল ডোরের পূর্বে ছোট উপসাগর, পোর্টল্যান্ড এবং পুরবেক চুনাপাথরের ব্যান্ডটি সম্পূর্ণরূপে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়নি এবং তরঙ্গের উপরে ম্যান ও ওয়ার রকস হিসেবে দৃশ্যমান। একইভাবে পশ্চিমে উপকূলীয়, ক্ষয়প্রাপ্ত চুনাপাথরের ফসল ছোট পাথুরে দ্বীপের একটি রেখা তৈরি করে যাকে বলা হয় (পূর্ব থেকে পশ্চিমে) The Bull, The Blind Cow, The Cow, and The Calf. যেহেতু এই অঞ্চলের উপকূল রেখা সাধারণত একটি ক্ষয়প্রাপ্ত ল্যান্ডস্কেপ, তাই পর্বতগুলো মাঝে মাঝে পাথর এবং ভূমিধসের শিকার হয়।

ডারডল দরজা সম্পর্কে ইতিহাস থেকে আরও জানা যায়, প্রায় ১০ হাজার বছর আগে পোর্টল্যান্ড চুনাপাথরের মধ্য দিয়ে সমুদ্র ভেদ করলে এটি তৈরি হয়েছিল। সৈকতের উপর পশ্চিম দিকে তাকানো, বিচ্ছিন্ন সমুদ্র শোতে স্তূপ দেখায় যেখানে একবার একটি পুরোনো উপকূল রেখা ছিল।

ডারডল দরজা সম্পর্কে অনেক বিশেষত্ব আছে। যা আপনার ভ্রমণ পিপাসু, গবেষক, অনুসন্ধানী মন খুঁজে বের করতে পারবে।

আমি যতদূর জেনেছি বা দেখেছি, ডারডল ডোর হলো জুরাসিক কোস্টের অন্যতম আইকনিক ল্যান্ডস্কেপ। এটি একটি প্রাকৃতিক খিলান, যা সমুদ্রের বাইরে প্রায় উল্লম্বভাবে দাঁড়িয়ে থাকা শক্ত চুনাপাথরের একটি স্তর থেকে গঠিত। ডারডল দরজা কাঠের ধাপের একটি সেট অনুসরণ করে একটি খাড়া পথের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছে। যা দেখতে অতি অসাধারণ, মুগ্ধকর, পেছনে সুউচ্চ পাহাড় আর সামনে বিশাল সমুদ্র। এখানে নিজের প্রিয়জন নিয়ে একবার বেরিয়ে আসতে পারেন। আর আলোকচিত্র শিল্পীদের ছবি তোলার জন্য একটি অনন্য স্থান।

ডরসেট আসবেন আর এটি দেখবেন না ছবি তুলবেন না, তা হতে পারে না। ডরসেটের কোনো ভ্রমণ ডার্ডল ডোর পরিদর্শন ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। চিত্তাকর্ষক চুনাপাথরের খিলান একটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং জুরাসিক উপকূলে একটি আইকনিক বৈশিষ্ট্য।

ডরসেট কাউন্টি শহরের আদি ইতিহাসের দিকে আরেকটু নজর দিলে জানা যায় যে ডরসেট কাউন্টি শহর ডরচেস্টার থেকে এর নামটি এসেছে। রোমানরা প্রথম শতাব্দীতে বসতি স্থাপন করে এবং এটির নাম দেয় ডুরনোভারিয়া, যা একটি সাধারণ ব্রিটোনিক শব্দের একটি ল্যাটিনাইজড সংস্করণ ছিল। সম্ভবত যার অর্থ ‘মুষ্টির আকারের নুড়িযুক্ত স্থান’।

ডরসেটের কোনো ভ্রমণ ডারডল ডোর পরিদর্শন ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। চিত্তাকর্ষক চুনাপাথরের খিলান একটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং জুরাসিক উপকূলে একটি আইকনিক বৈশিষ্ট্য। খিলানটি হাজার হাজার বছর ধরে সামুদ্রিক ক্ষয়ের ফলে ভারী বৃষ্টিপাত এবং বিশ্বাসঘাতক ঝড়ের ফলে তৈরি হয়েছিল। ডারডল ডোরের নিচে আশে পাশে সমুদ্রের ঢেউ, টলটলে স্বচ্ছ জল এককথায় অসাধারণ সৌন্দর্য।

আর এই ডারডল ডোর হলো যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে ছবি তোলা স্থানগুলোর মধ্যে একটি। একটি সুন্দর পরিষ্কার দিনে আপনি পোর্টল্যান্ডের দিকে উপকূল বরাবর অসাধারণ সৌন্দর্য দেখতে পাবেন। এটি দেখার মতো একটি বাস্তব দৃশ্য, দু’চোখ মেলে দেখবেন, একদিকে সমুদ্র অন্যদিকে পাহাড়।

দর্শনার্থীরা প্রায়শই জলের স্বচ্ছতা দেখে সমুদ্র পারে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। সাঁতার কাটতে নামেন দলবল, বন্ধুবান্ধব, পরিবার পরিজন ও অনেকেই প্রিয়জনকে নিয়ে। তবে এখানে পানিতে নামার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, কারণ সেখানে কোনো লাইফগার্ড সার্ভিস নেই। আমি দেখেছি সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায়ও এখানে পানির গভীরতা বেশি। পানি থেকে উঠলেই পাথরের ছোঁয়া। এখানে তীরবর্তী বালি কিংবা মাটির দেখা পাবেন না।

সৈকতটি একটি খাড়া ধাপের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে, যা পাহাড়ের মুখে তৈরি করা হয়েছে। সিঙ্গেল অ্যাক্সেস করার জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেক সত্ত্বেও ডারডল ডোর দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সৌন্দর্য স্পটগুলোর মধ্যে একটি এবং অবিশ্বাস্যভাবে ব্যস্ত হয়ে পরে পর্যটকদের ভিড় থাকে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে স্কুল ছুটির সময়। বিশেষ করে জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ভ্রমণের উত্তম সময়।

সৈকতের শেষের দিকে বেশ কয়েকটি গুহা তৈরি হয়েছে। ডারডল ডোরের পূর্বে ম্যান ও ওয়ার রয়েছে, যা আপনার ভ্রমণের সময় মিস করা উচিত নয়। এই প্রায়শই শান্ত সমুদ্র সৈকত সূর্যস্নানের জন্য উপযুক্ত স্থান এবং সমুদ্র সৈকতে একটি আনন্দময় দিন কাটানোর জন্য।

কীভাবে আসবেন?

ইংল্যান্ডের যেকোনো জায়গা থেকে আসতে পারবেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। ট্রেনে আসতে পারবেন অথবা নিজস্ব পরিবহনে বা প্রাইভেট কারে। সবকিছুর জন্য একটি পূর্বপরিকল্পনা করে নিলে ভালো অথবা গুগলের সহযোগিতা নিয়ে পরিকল্পনা করে নিলে ভ্রমণ সুন্দর হবে।

আমরা ডারডল ডোরে এসেছিলাম ট্রেনে করে। প্রথমে ট্রেনে করে পূর্ব লন্ডন থেকে ওয়াটার লু স্টেশনে এসে টিকেট কেটে উল স্টেশন পর্যন্ত এসেছি। তারপর স্টেশন থেকে বেরিয়ে চোখে পড়ল একটি সাইনবোর্ড, ডরসেট সিটি কাউন্টি থেকে আপনাকে স্বাগতম। পাশেই বাস স্টপ, বাসে উঠলাম ডারডল ডোরের উদ্দেশে। এ বাস স্টপ থেকে আপনিও বাস নং ৩০, ৫০ এবং এক্স ৫৪ ব্যবহার করতে পারবেন। তবে বাসে ওঠার আগে ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ করে উঠলে ভালো। বাসে বিনিময়ের জন্য আপনি ব্যাংক কার্ড, ওয়েস্টার কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন। আমরা ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করে দোতলা খোলা বাসের উপরে উঠলাম। পথে যেতে যেতে চোখে পড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, হাজার বছরের গ্রামীণ ঐতিহ্য, ক্যাসল, ট্যাংক মিউজিয়াম ডরসেটে সারি সারি ট্যাংক, বিভিন্ন খামার, গরু, ছাগল, ভেরী চষে বেড়াচ্ছে বিশাল মাঠে। এ দিনের আবহাওয়া ছিল আমাদের অনুকূলে।

তাছাড়া নিজস্ব গাড়িতে বা কারে ডারডল দরজা পর্যন্ত সহজে আসতে পারবেন। ডারডল ডোর ব্যক্তিগত মালিকানাধীন লুলওয়ার্থ এস্টেটে অবস্থিত এবং ডারডল ডোর হলিডে পার্ক বা লুঅর্থ কভের মাধ্যমেও অ্যাক্সেসযোগ্য। উভয় গন্তব্যে গাড়ি পার্ক রয়েছে এবং গাড়ি পার্কিং টিকিট দুটির মধ্যে বিনিময়যোগ্যভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ক্লিফটপ কার পার্ক থেকে, যা হলিডে পার্কের মাধ্যমে অ্যাক্সেস করা হয়, একটি নুড়ি পথ ধরে সৈকতে খাড়া হাঁটা আছে, যা পায়ের তলায় আলগা হতে পারে। আপনি যদি লুলওয়ার্থ কোভ থেকে হাঁটতে চান, তবে সেখানে লড়াই করার জন্য একটি খাড়া পাহাড় রয়েছে এবং আপনার ফিটনেস স্তরের ওপর নির্ভর করে মাইল পথটি ১৫ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টার মধ্যে সময় লাগবে।

আপনি যদি সমুদ্র সৈকতে ট্র্যাক করতে পছন্দ না করেন বা চলাফেরার সমস্যা থাকে যা হাঁটা কঠিন করে তোলে, তাহলে যাবেন না। শিশুদের সঙ্গে রাখবেন বা আনবেন তবে সতর্কতা অবলম্বন করবেন। শিশুদের জন্য দেখেছি কেউ কেউ ফ্রাম ব্যবহার করেছেন, তাদের কষ্টের শেষ নেই। এর জন্য ফ্রাম নিয়ে না আসাই ভালো। ডারডল ডোরের কাছাকাছি নামতে দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। এর জন্য অফুরন্ত সাহস দরকার।

এখানে যাওয়ার পূর্বে এগুলো বুঝেশুনে মনোবল নিয়ে যাবেন। আমি আমার পরিবার, দলবল নিয়ে ঘুরে এসেছি। আরও আছে ওয়েইমাউথ থেকে ডার্ডল এবং লুলওয়ার্থ কোভের দর্শনীয় নৌযান ভ্রমণ রয়েছে, যা আপনাকে সমুদ্র থেকে এই চিত্তাকর্ষক সাইটগুলোতে বিস্মিত করতে দেয়।

আরও অনেক সুবিধা আছে

সৈকত থেকে ফেরার সময় উপরে উঠে পথে গাড়িতে ফিরে চ্যালেঞ্জিং হাঁটার সময় আপনার তৃষ্ণা লাগবেই। তৃষ্ণা মেটাতে পানীয় এবং কপি শপ ও আইসক্রিম ভ্যান পাবেন। আইসক্রিম দেখে আমার মেয়ের মায়াবী আবদার তো বুঝতেই পারছেন। কপি, আইসক্রিম খেয়ে অবশিষ্ট অংশ বা পানির বোতল যত্রতত্রে ফেলে দেওয়া যাবে না। আমি দেখেছি সবাই নির্ধারিত জায়গায় রেখেছে। এখানে পরিবেশ প্রকৃতি রক্ষায় সবাই সচেতন। কেউ কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে কোথাও ধূমপান করেছেন।

আমরা এর বিরুদ্ধে ভদ্রভাবে প্রচারণা চালিয়েছিলাম। কারণ আমাদের এ ট্যুরটাই ছিল ক্যাম্পেইন ফর গ্লোবাল পিচ অ্যান্ড ড্রাগ ফ্রি সোসাইটির।

এখানে হাঁটার সময় দিকনির্দেশনা মেনে চলবেন। ওয়্যারহামের চিহ্নগুলো অনুসরণ করবেন। তাহলে আপনার ভ্রমণ সহজ ও আনন্দময় হবে নিশ্চয়ই। তাই একটু অবকাশ পেলে সাধ্যমতো ভ্রমণ করুন, মাদককে না বলুন, সুন্দর, শান্তিময় সমাজ গড়ে তুলুন। এটিই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে প্রত্যাশা।

এসএসএইচ