অবৈধ অভিবাসীদের কারণে ক্রমেই বদলে যাচ্ছে মালয়েশিয়ার অভিবাসন নীতি। দেশটির ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়াটাও জটিল। চলমান মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে শক্ত অবস্থানে রয়েছে দেশটি। পাশাপাশি সংকট উত্তরণে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে কাজ করছে সরকার।

এছাড়া দেশটিতে কর্মরত অভিবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, বাসস্থান, কাজের কর্মঘণ্টা শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করছে। যদি শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরে না আসে নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে জেল জরিমানার বিধানও করা হয়েছে।

গত বছরের নভেম্বরে ফের অবৈধদের রিকেলিব্রেশন নামে বৈধ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। এ প্রক্রিয়া চলবে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত।

এ প্রক্রিয়ায় কোনো দালাল বা ভেন্ডার না থাকায় কোম্পানির মালিক পক্ষের মাধ্যমে বৈধ হতে পারবেন। তবে মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইনের এ জটিলতার কারণে সবচেয়ে বিপাকে রয়েছে কয়েক লাখ অবৈধ বাংলাদেশি। আর এ জটিলতা উত্তরণে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন কাজ করে যাচ্ছে।

সঠিক পদ্ধতিতে বৈধতা নিতে বা চাকরি পেতে দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে চালু হয়েছে চাকরির খোঁজ নামে অনলাইন পোর্টাল। এ পোর্টালের মাধ্যমে কর্মীরা তাদের পছন্দমতো চাকরি পেতে সহায়তা দিচ্ছে হাইকমিশন।

এর আগে, বিগত বছর গুলিতে দেশটির সরকার অবৈধ অভিবাসীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। কিন্তু দেশি-বিদেশি দালাল চক্রের কারণে সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেনি শ্রমিকরা। পুরো মালয়েশিয়ায় লাখ লাখ অবৈধ বাংলাদেশি বৈধ না হওয়ার পেছনে অসাধু প্রবাসী দালালরা দায়ী। বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও দায় এড়াতে পারে না বলে অভিযোগ ছিল প্রবাসী শ্রমিকদের।

এবার দায় এড়াতে চলতি বছরে চলমান রিকেলিব্রেশন প্রক্রিয়ায় সঠিকভাবে বৈধ হওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে মালয়েশিয়া সরকারের সাথে দূতাবাস কাজ করছে বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে বিগত সময়ে অবৈধ অভিবাসী কর্মীদের বৈধকরণ প্রক্রিয়ায় জাল-জালিয়াতির সিন্ডিকেট ধরতে মাঠে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। গত ৮ এপ্রিল কুয়ালালামপুর ও তার আশপাশের ২২টি স্থানে চিরুনি অভিযান চালিয়ে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের অনলাইন ডাটাবেজ হ্যাকার সিন্ডিকেটের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে দেশটির ইমিগ্রেশন পুলিশ।

গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল! মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগের সাবেক অফিসারের সহায়তায় এই সিন্ডিকেট ২১ হাজার ৩৭৮টি ভুয়া অস্থায়ী কর্মসংস্থান পাস (পিএলকেএস) শনাক্ত করেছে দেশটির দুর্নীতি দমন কমিশন। জাল কর্মসংস্থান পাসপোর্ট বেশিরভাগ শিল্পকারখানা, বৃক্ষরোপণ ও সেবা খাতের।

গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে এক বাংলাদেশিকে গ্রেফতারের পর অননুমোদিত অস্থায়ী কর্মসংস্থান পরিদর্শন পাস (পিএলকেএস) পাসের বিস্তারিত তদন্ত শুরু করে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। গত বছর থেকে এই সিন্ডিকেট ও তাদের কার্যক্রম নজরদারি করা শুরু হলেও করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে তাদের চিহ্নিত করতে কিছুটা সময় লেগে যায়।

গ্রেফতার পাঁচজনের মধ্যে একজনের দাতুক উপাধি রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের তালিকায় প্রথমেই বাংলাদেশির নাম রয়েছে। অভিযানে ল্যাপটপ, পাসপোর্ট, নগদ অর্থসহ যাবতীয় সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে।

ইমিগ্রেশন ডিরেক্টর-জেনারেল দাতুক খায়রুল দাযাইমি দাউদ বলেন, মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন বিভাগের ডাটাবেইজ হ্যাক করে একটি সিন্ডিকেট। সেখান থেকে টাকার বিনিময়ে জাল টেম্পোরারি ওয়ার্ক ভিজিট পাস (পিএলকেএস) প্রিন্ট করে বিতরণ করছে।

মালয়েশিয়া দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৯ সেকশন ১৭ অনুচ্ছেদে আরও অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে তাদের শনাক্ত করা হবে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে জড়িত নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের মালয়েশিয়া থেকে কালো তালিকাভুক্ত করে বহিষ্কার করা হবে বলে জানান ইমিগ্রেশনের মহাপরিচালক দাতুক খায়রুল দাযাইমি দাউদ।

কুয়ালালাপমপুরসহ মালয়েশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় কর্মরত প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৭ সালে অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বৈধ হওয়ার জন্য ‘মাই ইজি ও বিএম’ নামে প্রকল্প চালু করে দেশটির তৎকালীন সরকার।

কিন্তু মালয়েশিয়ার আইন অনুযায়ী, কোনো বিদেশি নাগরিক সরাসরি ইমিগ্রেশনে ভিসা নবায়নের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। অভিবাসন নীতিতে স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমেই (মালয়েশিয়ান নাগরিক) ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়।

ফলে মালয়েশিয় এজেন্টরা আবার অবৈধ বিদেশি সংগ্রহ করতে সাব-এজেন্ট নিয়োগ করে করে। কারণ তাদের পক্ষে লাখ লাখ অবৈধ বিদেশিদের চেনা অসম্ভব। সাব-এজেন্টদের মাধ্যমে অবৈধ বিদেশি নাগরিক সংগ্রহ করা হয়।

প্রবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, সে সময় পুরো মালয়েশিয়াজুড়ে শক্তিশালী বাঙালি দালাল চক্র গড়ে ওঠে। পুরো দেশজুড়ে কয়েক লাখ অবৈধ প্রবাসীদের বৈধ করার জন্য ভেন্ডার ও দালাল চক্র বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালে ওই দুই প্রকল্প চলাকালে ইমিগ্রেশন কার্ডের (আই) মতো গুরুত্বপূর্ণ নথি কপি করে জাল আই কার্ড তৈরির মতো গুরুতর অপরাধ করে দেশি-বিদেশি একটি দালাল চক্র।

প্রবাসীরা বলছেন, দেশটির পুলিশ এখনও এ বিষয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন সময় কয়েকটি চক্র ধরাও পড়েছে। বাংলাদেশিরা নিজেরাই নিজের পায়ে কুড়াল মারছেন। এখানে যত অনিয়ম, সবই বাঙালিদের দিয়ে হচ্ছে। বাঙালিরা কোনো আইন মানেন না। সব ধরনের অপকর্মই তাদের দ্বারা সম্ভব। এক্ষেত্রে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ করার পাশাপাশি যারা নানা ধরনের অপরাধে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছেন প্রবাসীরা

শ্রমিকরা গ্রেফতার হলে মজুরি কাটছে?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, কিছু নিয়োগকর্তা বেতন-ভাতা নিষ্পত্তি এড়াতে অভিবাসী বিভাগকে তাদের নিজস্ব নিবন্ধিত বিদেশি কর্মীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। অভিযান শুরুর আগে নিয়োগকর্তারা যাতে আইন মেনে চলেন তা নিশ্চিত করার জন্য কয়েকটি কৌশল নিয়ে তদন্ত পরিচালনা করা হয়।

অস্থায়ী ওয়ার্ক পাস (পিএলকেএস) ধারক ও শুল্ক প্রদানের ক্ষেত্রেও এটি একই রকম। যদি কিছু ঘটে থাকে তবে শ্রমিকদের তদন্ত করা হবে। তাদের নির্ধারিত মজুরি দেওয়া হয়েছে কি না তা দেখা হবে। যেখানে তারা নিযুক্ত ছিল ও কে তাদের নিয়োগ করেছে সংশ্লিষ্ট বিভাগে তাদের পক্ষে দাবি (অবৈতনিক মজুরি) করা হবে।

সব পক্ষকে ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে দেশটির সরকার। ৯ এপ্রিল দেওয়ান সারবাগুনা বান্দর বারু তম্বুনে মালয়েশিয়ার প্রহাহাতিন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি হামজাহ জায়নুদ্দিন এসব কথা বলেন।

হামজাহ বলেছেন, বৃক্ষরোপণ খাতে ৪০ হাজার বিদেশিকর্মী আনার জন্য নিয়োগকর্তারা অনুরোধ করেছিলেন। তবে, সরকারকে এই খাতে বিদেশি কর্মী নিয়োগের অনুমতি দেওয়ার আগে টিকাদান, কোয়ারেন্টাইন ও আবাসন সম্পর্কিত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে আরও তদন্তের প্রয়োজন।

তিনি বলেন, আমরা যদি তাদের প্রবেশের অনুমতি দেই, তবে করোনা টেস্ট, কোয়ারেন্টাইন ও নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে কি না তা নির্ধারণ করতে হবে।

করোনা মহামারির কারণে বৃক্ষরোপণ শিল্পে বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। জানা গেছে যে ২ লাখ ২০ হাজার স্থানীয় ও ২ লাখ ৬৫ হাজার ৩৯৭ বিদেশি শ্রমিক নিবন্ধিত থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় বৃক্ষরোপণ খাতে এখনও ৫ লাখের বেশি শ্রমিকের প্রয়োজন।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ার নিবন্ধিত ১৫ লাখেরও বেশি অভিবাসী শ্রমিকের ৯১ শতাংশই এমন পরিবেশে বসবাস করে যা দেশটির ন্যূনতম আবাসন সুবিধার সঙ্গে যায় না। মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে আসা লাখো অনিবন্ধিত অভিবাসী শ্রমিক রয়েছে।

গত বছর লকডাউনের মধ্যেই অবৈধ অভিবাসীদের ধরতে অভিযান পরিচালনা করে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ। এ প্রক্রিয়ায় হাজারো অবৈধ শ্রমিককে আটক করা হয়েছিল।

এ বিষয়টি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কঠোর সমালোচনায় পড়েছিল। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ধারণা, মালয়েশিয়ায় ২০ থেকে ৪০ লাখের মতো অনিবন্ধিত শ্রমিক রয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অভিবাসী নির্ভর এ দেশটির অর্থনীতিগুলোকে শ্রমিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে হবে। মানবিক ও রাজনৈতিক বিবেচনা বাদ দিয়েও স্রেফ অর্থনৈতিক স্বার্থে তাদেরকে এটা করতে হবে বলে বলছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, করোনা মহামারি পুরো বিশ্বকে দেখিয়েছে কীভাবে সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ থেকে ছড়িয়ে পড়া সংকটে পুরো দেশ ও বিশ্ব কাবু হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের মতো রেমিট্যান্স নির্ভর অর্থনীতিগুলো নিয়োগদাতা দেশগুলোর সঙ্গে দর কষাকষি করতে হবে। শ্রম বৈষম্যের শিকার হয়েছে লাখো অভিবাসী শ্রমিক। কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সংস্থার অব্যাহত চাপে শ্রমিকদের অধিকার মজুরি নিশ্চিত ও মোটামুটি ভালো জায়গায় থাকা-খাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অবৈধ মানবপাচার নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থার পাশাপাশি জীবিকার তাগিদে ও অজ্ঞতায় এ জীবন বেছে নেওয়া অভিবাসীদের প্রতি সব পক্ষের সংবেদনশীল হওয়া উচিত।

ওএফ