জার্মানির বিরোধীদলীয় নেতা ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস আরও একবার শরণার্থী ইস্যুতে পপুলিস্ট বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। শরণার্থীদের রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাওয়ার অধিকারকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার বিষয়টি এবারই প্রথম নয়।

জার্মানির মধ্য-ডানপন্থি বিরোধী দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস প্রায়ই অভিবাসন এবং জার্মান সমাজে অভিবাসীদের একীভূত করা নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এবার তিনি তার বক্তব্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, আশ্রয় আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়া অভিবাসীরাও বিনামূল্যে উদার স্বাস্থ্যসেবা পান, যখন জার্মানিতে বসবাসরত অন্য অনেকে সেটা পান না।

জার্মানির বেসরকারি টিভি চ্যানেল ভেল্ট টিভিকে ম্যার্ৎস বলেন, মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে যায় যখন তারা দেখে যে তিন লাখ আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে কিন্তু তারা দেশ ছেড়ে যান না এবং সম্পূর্ণ সুবিধা পান, সম্পূর্ণ চিকিৎসা সেবা পান। তারা ডাক্তারের কাছে বসে দাঁত ঠিক করান, যখন পাশের বাড়ির জার্মান নাগরিকেরা ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্টই পান না।

চিকিৎসক ও নানা শরণার্থী সংস্থাও তার এমন মন্তব্য খণ্ডন করেছে। মধ্য-বামপন্থি রাজনীতিবিদরা এ নিয়ে ক্ষোভও জানিয়েছেন।

শরণার্থীদের আগমনের সংখ্যা সীমিত করাকে ঘিরে জার্মানির অভিবাসন নীতি নিয়ে এখন বিতর্ক তুঙ্গে। আশ্রয়প্রার্থীদের বিশেষ সুবিধা নিয়ে এমন সব মিথ্যা তথ্য এই বিতর্কে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তবে জার্মানিতে কে কী সুবিধা পায় তা মূলত শরণার্থীর পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।

স্বাস্থ্যসেবা

আশ্রয়প্রার্থীরা শুধু জরুরি ক্ষেত্রেই চিকিৎসা এবং দাঁতের রোগের সেবা পান। গুরুতর আঘাতের মতো যেসব জরুরি চিকিৎসা হাসপাতালে করা আবশ্যক, সেগুলোর ক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ দপ্তর খরচ বহন করে।

জার্মানির ১৬টি ফেডারেল রাজ্যে স্বাস্থ্যসেবা ভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। অনেক রাজ্যে চিকিৎসা গ্রহণের আগে আশ্রয়প্রার্থীদের সংশ্লিষ্ট সমাজকল্যাণ অফিস থেকে চিকিৎসাপত্রের জন্য আবেদন করতে হয়।

একবার আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর হয়ে গেলে বা জার্মানিতে বসবাসের ১৮ মাস পর শরণার্থীরা বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যবিমা তহবিল থেকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিষেবা পান। তবে কসমেটিক সার্জারির মতো বিষয়গুলো স্বাস্থ্যবিমার আওতায় পড়ে না।

বাসস্থান

শুরুর দিকে আশ্রয়প্রার্থীদের সাধারণত প্রাথমিক অভ্যর্থনা কেন্দ্রে রাখা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো সাবেক সামরিক ব্যারাকের মতো বড় বাসস্থান। এ ধরনের বাসস্থানে এক রুমে কয়েকজন থাকেন, আলাদা রান্নাঘর থাকে না। তবে তাদের খাবার সরবরাহ করা হয়। প্রাথমিক অভ্যর্থনা কেন্দ্রে থাকার সময়কাল কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাসও হতে পারে। তবে এর সর্বোচ্চ সময় ১৮ মাস।

এসময়ের পর তাদের বিভিন্ন পৌরসভায় আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সেটা জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র, হোস্টেল বা শরণার্থীদের যৌথ আবাসন হতে পারে।

যৌথ আবাসন ইউনিটে কয়েক ডজন থেকে কয়েকশ মানুষকে একসঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করা যায়। অনেকক্ষেত্রে একসঙ্গে ব্যবহারের মতো রান্নাঘর ও বাথরুম এবং শিশুদের খেলার সরঞ্জাম থাকতে পারে। কখনো কখনো শহরের প্রত্যন্ত এলাকাতে শরণার্থীদের বিভিন্ন বাড়িতে রাখা হয়। মাঝে মধ্যে শরণার্থীদের অন্য চার-পাঁচজনের সঙ্গে বাড়ি ভাগ করে নিতে হয়।

আশ্রয় প্রক্রিয়া চলাকালে আশ্রয়প্রার্থীদের চলাফেরার স্বাধীনতা সীমিত থাকে। এসময়ে এবং কখনো কখনো এরপরও তাদের নির্ধারিত জায়গায় থাকতে হয়। শুরুতে তারা কোনো কাজ করতে পারেন না, জার্মান ভাষা শেখার ক্লাসেও তারা যোগ দিতে পারেন না।

আর্থিক সহায়তা

আশ্রয়প্রার্থীরা কী অধিকার পাবেন, সেটা ‘অ্যাসাইলাম সিকারস বেনিফিট অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়।

যদি আশ্রয়প্রার্থীরা একটি প্রাথমিক অভ্যর্থনা সুবিধা বা ভাগাভাগি করা আবাসনে থাকেন, তাহলে তাদের ‘নিত্যপ্রয়োজনীয়’ হিসেবে বিবেচিত পণ্য সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে খাদ্য, বাসস্থান, তাপ, পোশাক, স্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত যত্নের পণ্য এবং গৃহস্থালির পণ্য। আশ্রয়প্রার্থীরা দৈনন্দিন খরচের জন্য অর্থ পাওয়ার অধিকারও রাখেন। অবিবাহিত আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য এই অর্থ সহায়তার পরিমাণ বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় দেড়শ ইউরো।

খাদ্য, পোশাক এবং অন্যান্য দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি সরবরাহ না করা হলে আশ্রয়প্রার্থীদের মাসে ৩৬৭ ইউরো করে দেওয়া হয়।

আর আশ্রয়প্রার্থীরা স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করলে আরও ২০০ ইউরো পর্যন্ত পেয়ে থাকেন।

প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থী

যেসব রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে তাদের অবশ্যই জার্মানি ছেড়ে যেতে হবে। তবে তাদের দেশে যদি যুদ্ধ চলে বা সেখানে অত্যাবশ্যক স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার আশঙ্কা থাকে বা তাদের নথি না থাকে, সেক্ষেত্রে তাদের ফিরে যেতে বাধ্য করা যাবে না।

এসব ক্ষেত্রে তাদের সাময়িকভাবে জার্মানিতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয় এবং ডুলডুং (আপাতত মেনে নেওয়ার ব্যবস্থা) দেওয়া হয়। বর্তমানে জার্মানিতে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার মানুষের এ ধরনের আশ্রয় ব্যবস্থা রয়েছে।

এ ধরনের অভিবাসীরাও আশ্রয়প্রার্থীদের মতোই অ্যাসাইলাম সিকারস বেনিফিট অ্যাক্টের অধীনে সম্পূর্ণ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী। দীর্ঘ সময়ের জন্য জার্মানিতে থাকলে তাদের চাকরি বা প্রশিক্ষণ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

এছাড়াও জেনেভা কনভেনশনের অধীনে জার্মানি এমন সব শরণার্থীদের গ্রহণ করে যারা একটি নির্দিষ্ট জাতি, ধর্ম বা সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কারণে নিপীড়নের হুমকিতে রয়েছেন। তারা কোনো আশ্রয় বা অন্যান্য স্বীকৃতির প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যান না। আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। নিজেরা সমর্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা এ সুবিধার অধিকারী হন।

ইউক্রেনের শরণার্থীদের বিশেষ সুবিধা

ইউক্রেন থেকে প্রায় ১১ লাখ শরণার্থী জার্মানিতে বিশেষ ব্যবস্থায় আশ্রয় পেয়েছেন। কোনো আশ্রয় প্রক্রিয়া ছাড়াই দুই বছরের জন্য অস্থায়ী সুরক্ষার জন্য তাদের বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কাজ করার তাৎক্ষণিক এবং অবাধ সুবিধা।

যারা কাজ করতে পারছেন না তারা অন্যান্য সুবিধা পান। এসব সুবিধার মধ্যে রয়েছে আবাসন এবং জার্মান নাগরিকদের ব্যুর্গারগেল্ড বা নাগরিকের আয় নামে একটি বিশেষ আর্থিক সুবিধা। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, একজন অবিবাহিত প্রাপ্ত বয়স্ক জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের জন্য মাসে ৫০২ ইউরো পেয়ে থাকেন। নিয়মিত স্বাস্থ্যবিমাও পান তারা।

সূত্র : ইনফোমাইগ্রেন্টস

/এসএসএইচ/