আইভী-তৈমূরের জয়-পরাজয়ে হকার-চালকদের যত শঙ্কা
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, শহরের ভ্রাম্যমাণ হকার ও অটোরিকশাচালকদের কাছে হিসাব-নিকাশ যেন ততই জটিল হয়ে উঠছে। তারা বলছেন, এ নির্বাচনের ফলের পরে তাদের জীবন-জীবিকায় দু ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী জয়ী হয়ে উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখলে এক ধরনের প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী সদ্য বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া তৈমূর আলম খন্দকার জয়ী হলে আরেক ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
বিজ্ঞাপন
হকার ও চালকরা বলছেন, তাদের দিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থীদের কোনো নজর নেই। সমাজের অন্য শ্রেণী-পেশার লোকজন নিয়ে মেয়র প্রার্থীদের বিভিন্ন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থাকলেও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন কোনও প্রতিশ্রুতি পাচ্ছেন না। তাদের আক্ষেপ, সমাজের অবহেলিতদের দেখার কেউ নেই। তবে প্রার্থীদের প্রতিনিধিরা বলছেন, হকার ও চালকের নিয়ে অল্প হলেও পরিকল্পনা রয়েছে।
বর্তমান মেয়র আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলমের জয়-পরাজয়ের ওপর রুটি-রুজি ও পরিবারের ভরণপোষণ অনেকটাই নির্ভর করে বলে মনে করেন নিম্নআয়ের এ দুই পেশার মানুষ। তাদের ভয়, আইভী জয়ী হলে শহর থেকে হকারদের উচ্ছেদ করা হবে, অটোরিকশাচালকরা শহরে প্রবেশ করতে পারবেন না। অন্যদিকে তৈমূর আলম খন্দকার জয়ী হলে সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে । সেক্ষেত্রে এর প্রভাবও তাদের জীবন-যাপনে প্রভাব পড়বে।
ভ্রাম্যমাণ হকাররা বলছেন, গত নির্বাচনে জয়ী হয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভী মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর হকার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেন। তখন অনেক হকার বেকার হয়ে পড়েন। এখনো শহরে যে হকাররা রয়েছেন, তারা সবসময় পুলিশের আতঙ্কে থাকেন। কয়েক ঘণ্টা পরপর তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে হয়। ঘণ্টায় ঘণ্টায় জিনিসপত্র গুছিয়ে বিভিন্ন গলিতে অবস্থান নিতে হয়। আবার পুলিশ চলে গেলে ফুটপাতে বসেন তারা। এবারো আইভি নির্বাচনে জয়ী হলে এ উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত থাকবে। এতে তাদের রুটি-রুজির ওপর আঘাত আরও তীব্র হবে। পরিবারের ভরণপোষণের সমস্যাও বাড়বে।
অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া তৈমূর আলম খন্দকার মেয়র পদে জয়ী হলে হকারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করবেন কি না, বা তাদের জন্য কী করবেন, সে বিষয়ে তার নির্বাচনী ইশতেহারে কোনো কিছু বলা নেই, তিনি কোনও প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন না। ফলে, হকার ও অটোচালকরা এক ধরনের ভয়ে রয়েছেন।
হকাররা মনে করেন, তৈমূর আলম খন্দকার মেয়র পদে জয়ী হলে তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হতে পারে। এটি তাদের জন্য ভালো। কিন্তু তৈমূর যেহেতু বিরোধীদলের লোক, সেহেতু সিটি করপোরেশনের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব কম থাকবে। এতে তাদের ওপর বিভিন্ন মহল থেকে হয়রানি এবং চাঁদাবাজির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে শহরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও স্থবির হয়ে যেতে পারে। কারণ বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে তিনি সরকারের সহযোগিতা পাবেন না। এতে নাগরিক সেবার মান কমে যাবে। শহরে নতুন নতুন অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
নারায়ণগঞ্জ শহরে চাষাড়া এলাকায় কথা হয় ভ্রাম্যমাণ হকার উজ্জ্বল চন্দ্র দাসের সঙ্গে। তার বাড়ি কুমিল্লা, কিন্তু জন্ম নারায়ণগঞ্জে। তিনি এ সিটির ভোটার। তার পরিবারে আরও তিনজন ভোটার রয়েছেন। তিনি জানান, গত আট বছর ধরে কষ্টে আছেন। কোথাও টানা এক ঘণ্টাও দোকানদারি করতে পারেন না। কারণ পুলিশ এলেই সবকিছু মাথায় নিয়ে কোনো গলিতে অবস্থান নিতে হয়। এভাবে সারাদিন চলতে থাকে। ফলে হাজার টাকারও দোকানদারি হয় না।
তিনি বলেন, ‘আইভী আপা মেয়র হওয়ার পর থেকে দফায়-দফায় হকার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা হয়েছে। আমরা ভালো নেই। আমাদের দেখাও কেউ নেই। কিন্তু তারপরও কষ্টে জীবন চলে যাচ্ছে আমাদের ভোট তাদের দরকার নেই মনে হয়। দরকার হলেও তো আমাদের খোঁজ নিতে আসতেন।’
১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বালুর মাঠের পাশের দোকানদার জহিরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল। মা ও বাবা দুজনই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ভোটার। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে তৈমূরের হাতি জিতলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ হওয়া শঙ্কা রয়েছে। আবার আইভী জিতলে হকারদের উচ্ছেদের শঙ্কা রয়েছে। ফলে, শহরের সব কিছু বিবেচনা নিয়ে নির্বাচনে হকারদের ভোট দিতে হবে।’
নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের বিপরীত সড়কে ফুটপাতে কথা হয় জুতা বিক্রেতা মোফিজুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আট বছর ধরে কষ্ট করছি। তারা আমাদের এ কষ্ট তো বোঝেন না।’ কথা বলতে বলতেই পুলিশ এসে যায়, মোফিজুল জুতার বস্তা গুছিয়ে গলিতে অবস্থান নেন। তিনি আরও বলেন, ‘এই দেখেন না, কীভাবে আমরা আছি। এভাবে করে সারাদিন থাকতে হয়। মেয়র আমাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করে হকার উচ্ছেদ করলে আমাদের এতো কষ্ট থাকতে হতো না।’
ভোট কাকে দেবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইভী শহরে অনেক কাজ করেছেন, আবার হকার উচ্ছেদ অভিযানও পরিচালনা করেছেন। অন্যদিকে, তৈমূর আমাদের জন্য ভবিষ্যতে কী করবেন, তা আমরা এখনো জানি না। এখন দেখি কাকে ভোট দেওয়া যায়।’
মোফিজুলের পাশে জুতা বিক্রিতে বসেছেন আরেক ভ্রাম্যমাণ হকার শহীদুল ইসলাম। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে কোন প্রার্থীর অবস্থা ভালো জানতে চাইলে— তিনি বলেন, ‘নৌকার মিছিল-মিটিং তো ভালো। তবে, তৈমূর সাহেব বেটা আছেন। কোনো কিছু হলে জান দিয়ে দেবেন। তারপরও ভোটে কিছু করতে দেবেন না।’
বর্তমান মেয়রের হকার উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে শহীদুল বলেন, ‘পুলিশের ভয়ে সারাদিন বসা-ওঠার মধ্যে থাকতে হয়। এই কারণে বেচা-বিক্রিও খুব একটা ভালো হয় না। আমাদের নিয়ে মেয়র প্রার্থীরা কোনো বক্তব্য দেননি।’
তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জ শহরে ডিআইটি মোড় থেকে চাষাড়া মোড় পর্যন্ত ফুটপাতে বাদাম, পেয়ারা-শসা, ফল, জুতা-কাপড় বিক্রেতা মিলে প্রায় চার হাজার হকার রয়েছেন। তাদের সবাইকে সারাদিন ওঠা-বসার মধ্যে দোকানদারি করতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহরের বিভিন্ন এলাকায় ইজিবাইক, অটোরিকশাচালক রয়েছেন ১৫ হাজারের মতো। তাদের অনেকে পরিবার নিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করছেন। নারায়ণগঞ্জ শহরের অটোচালকদের অভিযোগ, শহরের বেশ কয়েকটি জায়গায় (চানমারী, চাষারা মোড়, কালিবাড়ি ও রেলগেট) তারা ভাড়া নিয়ে যেতে পারেন না । মেয়রের নির্দেশে পুলিশ তাদের যেতে দেয় না। এ কারণে কয়েকটি গলিতেই তাদের ঘোরাফেরা করতে হয়।
আগামী নির্বাচনে আইভী আবারো মেয়র নির্বাচিত হলে তাদের চালকদের ঘোরাফেরার জায়গা আরও সঙ্কুচিত হবে। তবে, আইভী মেয়র থাকার কারণে শহরে সড়ক ও অলি-গলি ভালো আছে। ফলে চালকরা স্বচ্ছন্দে গাড়ি চালাতে পারেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার মেয়র নির্বাচিত হলে তাদের জন্য কী করবেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছুই বলছেন না।
নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে কথা হয় ইজিবাইকচালক আকরামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভোটের পরে যদি সত্যিই আমাদের উচ্ছেদ করে দেয় বিকল্প ব্যবস্থা না করে দিয়ে, আমি নিশ্চিত আপনারা অনেক আত্মহত্যার গল্প লিখবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কাজ করে খাই এখন। যখন কাজ থাকবে না পরিবারের ভরণপোষণে তো কিছু আমাদের করতেই হবে। অনেকে তখন ভিন্ন কোনো পথ বেছে নেবে, যা সমাজের জন্য ভালো হবে না।’
আকরামের পাশে অটোরিকশায় বসে থাকা আলম মিয়া বলেন, ‘আমাদের দেখার কেউ নেই। ভোটের আগে প্রার্থীরা অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও ভোটের পরে সব ভুলে যান।’
নগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও মেয়র আইভীর ছোট ভাই আলী রেজা উজ্জ্বল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নগরের সব নাগরিকের সুবিধা-অসুবিধা মাথায় রেখেই মেয়র আইভী কাজ করেছেন। আগামীতেও তাই করবেন। শ্রমজীবীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা হয়েছে আইভীর।’
আইভীর নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রাফিউর রাব্বী বলেন, ‘তাদের নজরে রাখা বা তাদের কাছে প্রার্থীদের যাওয়ার প্রকৃত অর্থে সুযোগ নেই। কারণ তাদের নির্দিষ্ট কোথাও পাওয়ার ঠিকানা নেই। তবে, তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জে হকারদের সঙ্গে বড় ঘটনা ঘটে বর্তমান মেয়রের। তখন মেয়র আইভী হকারদের জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা বরাদ্দ দিয়ে দোকানও করে দেন। হকাররা তা বিক্রি করে অথবা আত্মীয়-স্বজনদের দিয়ে আবারও ফুটপাতে ব্যবসা শুরু করেন। এই হলো অবস্থা।’
হকারদের ভোট সংখ্যা কেমন জানতে চাইলে রফিউর রাব্বী বলেন, ‘মোট ভোটার সংখ্যার ১০ শতাংশ মতো হবে।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূরের নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত এস এম আকরাম বলেন, ‘শ্রমজীবী মানুষ ও হকারদের উচ্ছেদের আগে বিকল্প ব্যবস্থা করে দেওয়ার একটি প্রতিশ্রুতি মেয়র প্রার্থী তৈমূর দিয়েছেন। বর্তমান মেয়র দায়িত্ব পালনকালে এ শহরে হকারদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তৈমূর মেয়র নির্বাচিত হলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটবে না, পরিকল্পনা করেই উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
এবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াত আইভী, স্বতন্ত্র প্রার্থী সদ্য সাবেক বিএনপির নেতা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার ছাড়াও রয়েছেন খেলাফত মজলিসের প্রার্থী এ বি এম সিরাজুল মামুন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থী মো. জসিম উদ্দিন, ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মাওলানা মো. মাসুম বিল্লাহ ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির প্রার্থী মো. রাশেল ফেরদৌস। ১৬ জানুয়ারি নাসিক নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
এএইচআর/আরএইচ