‘নারী মুক্তির সবচেয়ে বড় বাধা পুঁজিবাদ’
সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সভাপতি রওশন আরা রুশো বলেছেন, নারী মুক্তির সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হলো পুঁজিবাদী আর্থসামাজিক ব্যবস্থা। ধর্ষণ, বিচারহীনতা, মৌলবাদ, ভোগবাদ, পুরুষতন্ত্র-এসবই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনুষঙ্গ। পুঁজিবাদ সবকিছুকেই পণ্যে পরিণত করে, মানুষের অধিকার, হৃদয়বৃত্তি, সেবা কোনো কিছুই বাদ পড়ে না মুনাফার চোখে। পুঁজিবাদের কাছে নারীও পণ্য।
শুক্রবার (৭ জানুয়ারি) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কাউন্সিল উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
বিজ্ঞাপন
রুশো বলেন, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে সরকারি হিসাব মতেই প্রায় ২০ হাজার নারী পাচার করে বিভিন্ন দেশের পতিতালয়, নাইট ক্লাব, ক্যাসিনোতে বিক্রি করা হয়। নারী দেহকে পণ্য বানিয়ে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার পর্নোগ্রাফি ও ব্লুফিল্ম বিক্রি করা হয় আর সঙ্গে চলে মাদক ব্যবসা। নারী মুক্তি আন্দোলন কোনো সমাজবিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। পুরুষদের বিরুদ্ধে নারীদের লড়াই নয়। নারীর অধিকার ও মর্যাদা সমাজের সব মানুষের অধিকার ও মর্যাদার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
সভায় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী চলছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারের ঘোষণা দিয়ে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। বিগত ৫০ বছরে যারাই দেশ পরিচালনা করেছে তারাই এ ঘোষণার বিপরীতে হেঁটেছে। ফলে সাম্যের পরিবর্তে বৈষম্য বেড়েছে। এর নির্মম শিকার নারী-পুরুষ উভয়ই। পুঁজিবাদী সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে নানাদিক দিয়ে আরও উৎসাহিত ও শক্তিশালী করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে নারীরাও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করেছে অথচ তার কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নাই। সমাজে নারীরা দ্বৈত শোষণের শিকার হচ্ছে। মানবিক মর্যাদা ধূলিস্যাৎ হয়েছে একের পর এক নিপীড়ন নির্যাতনের ঘটনায়।
তিনি আরও বলেন, পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো স্বাধীন দেশের সংবিধানে নারীকে আইনত বানিয়ে দিয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। অথচ আমরা জানি সভ্যতা মানে মানব সভ্যতা, পুরুষ বা নারী সভ্যতা নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কখনোই মানুষের মুক্তি দিতে পারে না, সার্বিকভাবে নারী মুক্তিও এখানে সম্ভব নয়। শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সমাজ পরিবর্তনের লড়াই প্রয়োজন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তে শোষণহীন সাম্য সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের লড়াই জোরদার করতে হবে। ফলে নারী মুক্তির আন্দোলনকেও সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে রূপান্তর করার সংগ্রাম মহিলা ফোরামকে জারি রাখতে হবে।
সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী শম্পা বসু বলেন, দেশের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে নারী নির্যাতন হয় না। ঘরে-বাইরে, পাহাড়ে, সমতলে, গণপরিবহনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, হাসপাতালে, থানা হাজতে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও নারীরা ধর্ষণ নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। গত বছর বাংলাদেশ বাল্যবিবাহের হারের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম ও বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ হয়েছে। গণপরিবহনে ৯৪ শতাংশ ও পোশাক কারখানায় ৮০ শতাংশ নারী মৌখিক, দৈহিক বা যেকোনো ধরনের যৌন নিপীড়নের শিকার হন। এছাড়া পরিবারে নারীর হাড়ভাঙা পরিশ্রমেরও কোনো মূল্য নেই বললেই চলে।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন— সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট দিলরুবা নূরী, চা শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা ও মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার ৪নং মুন্সীবাজার ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসনের নবনির্বাচিত সদস্য চা শ্রমিক কাজল রায়, মহিলা ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডা. মনীষা চক্রবর্তী ও রুখশানা আফরোজ আশা।
সমাবেশ শেষে ২য় কাউন্সিলের মাধ্যমে গঠিত তৃতীয় কমিটি পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে প্রকৌশলী শম্পা বসুকে সভাপতি, অ্যাডভোকেট দিলরুবা নূরীকে সাধারণ সম্পাদক ও ডাক্তার মনীষা চক্রবর্তীকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়।
এমএইচএন/এসএসএইচ