শরিকরা দুষছেন, ‘পর্যবেক্ষণে’ আওয়ামী লীগ
কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কয়েকটি স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় ভাঙচুর এবং বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা। তারা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
বিপরীতে দলটির (আওয়ামী লীগ) নেতৃস্থানীয়রা বলছেন, তারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন। একই সঙ্গে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকতে বলেছেন।
বিজ্ঞাপন
গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের অস্থায়ী মন্দিরে পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে সহিংস ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে তা দেশের কয়েকটি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পূজামণ্ডপ ও বাড়িঘর ভাঙচুর, এমনকি কোথাও কোথাও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে
গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের অস্থায়ী মন্দিরে পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে সহিংস ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে তা দেশের কয়েকটি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পূজামণ্ডপ ও বাড়িঘর ভাঙচুর, এমনকি কোথাও কোথাও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে।
এসব ঘটনায় ১৩ থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত মারা যান নয়জন। এর মধ্যে ছয়জন মুসলিম ও তিনজন হিন্দু। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ।
সহিংসতার এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপি-জামায়াতকে দোষারোপ করছে। দলটির নেতারা বলছেন, দেশে বিভিন্ন সময় তাদের নেতৃত্বে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এবারও আগামী নির্বাচনকে (দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন) ঘিরে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে তারা হামলা চালিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, দুই বছর পর দেশে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন থেকে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রও জড়িত। হিন্দুরা আমাদের ভোট ব্যাংক। আমরা কেন সেই ভোট ব্যাংক নষ্ট করব? দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে সরকারের কী লাভ? বরং স্থিতিশীল থাকলে দেশের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায় থেকে বিএনপি-জামায়াতের ওপর দোষ চাপানো হলেও ক্ষমতাসীন জোটের (১৪ দলীয় জোট) শরিকরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর তাণ্ডব মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, নেতাকর্মী ও স্থানীয় প্রশাসন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ব্যর্থতার মাশুল দিতে হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে
এদিকে, কুমিল্লার ওই ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সফর করেন আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল। পরে তারা চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী সফর করেন। সেখানে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেন। জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গেও বৈঠক করেন তারা।
প্রতিনিধিদলের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এসব ঘটনার পেছনে গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার বিষয়টি সামনে এসেছে। কুমিল্লার একটি ঘটনা নিয়ে টানা কয়েক দিন যে ঘটনা ঘটেছে সেটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগে থেকে আঁচ করতে পারেনি বা তথ্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এটি স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। মণ্ডপের তুলনায় তাদের (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) জনবল সংকটের কথা বলেছেন তারা।’
তিনি আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়টিও সামনে এসেছে। সংগঠন শক্তিশালী না হওয়ায় ওই এলাকাগুলোর তাণ্ডব মোকাবিলা করা যায়নি।
‘ক্ষতিগ্রস্তরা আমাদের বলেছেন, তারা হামলাকারীদের চেনেন না। প্রায় সবাই বহিরাগত। এক্ষেত্রে প্রশাসন ভিডিও দেখে হামলাকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। হামলায় জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীরা ছিলেন বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা আমাদের জানিয়েছেন।’
পূজামণ্ডপে হামলার ওই ঘটনার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় এক কর্মসূচিতে বলেন, গত ১২ বছর দুর্গাপূজার হাজার হাজার মণ্ডপে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। অথচ এবার পরিকল্পিতভাবে একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় সারা বাংলাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায় থেকে বিএনপি-জামায়াতের ওপর দোষ চাপানো হলেও ক্ষমতাসীন জোটের (১৪ দলীয় জোট) শরিকরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর তাণ্ডব মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, নেতাকর্মী ও স্থানীয় প্রশাসন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ব্যর্থতার মাশুল দিতে হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে।
১৪ দলীয় জোটের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আওয়ামী লীগ সবসময় নিজেদের শক্তিশালী দল বলে থাকে। সেই শক্তিশালী দলের ভূমিকা সাম্প্রতিক সময়ে কোথায় গেল? সংখ্যালঘুরা তো তাদের ভোট দেয়। আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের আস্থা ছিল। সেই আস্থায় এখন চিড় ধরেছে।
তিনি আরও বলেন, দলটির একটি অংশ লুটপাটে ব্যস্ত। অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে কাজ করতে হবে, সেটি এখন তাদের মধ্যে নেই।
এ বিষয়ে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, যখন আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে তুষ্ট করতে নামে তখন তারা সামনে আসে। যে আদর্শ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সেটি কিন্তু আজ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভূত আমাদের জনগণের ওপর চেপে বসেছে।
তিনি বলেন, সহিংস এসব ঘটনার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে না তুললে এটি ঘটতেই থাকবে। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থায় হয়তো তুষের আগুন কিছুটা নিভবে। কিন্তু কিছুদিন পর আবারও সেখান থেকে ধোঁয়া বের হবে।
গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন বলেন, এটি দেশি-বিদেশি বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করি। ঘটনাগুলোর পেছনের কুশীলব কারা, তাদের খুঁজে বের করতে হবে।
স্থানীয়পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর অনেক নেতাকর্মী সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক স্ট্যাটাস সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দিয়েছেন। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকে সংগঠন থেকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, স্থানীয়ভাবে আমাদের কিছু নেতাকর্মী এসব ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছেন। আমাদের কাছেও এমন তথ্য এসেছে। এগুলো আমাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। কারণ, তারা আমাদের দল করলেও দলীয় আদর্শ ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরাও ব্যর্থ হয়েছি। এখন আমাদের উচিত হবে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের কাউন্সেলিং করা। তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক চেতনা গেঁথে দেওয়া।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেন, এসব ঘটনা থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি ধর্মীয় স্কলারদেরও যুক্ত করতে হবে। ইসলামে যে অন্য ধর্মের মানুষের নিরাপত্তার জন্য বিধান রয়েছে, সেগুলো প্রচার করতে হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গা উৎসবের সময় একটি ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে এতে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। সরকার ও দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে জড়িতদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবে।
তিনি বলেন ‘আওয়ামী লীগের মূল বক্তব্যই হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতা। এখানে আমাদের দলের নেতাকর্মীদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। এ দেশের সব সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে নিরাপদে থাকতে পারে সেজন্য নেতাকর্মীদের মাঠে থেকে জনগণকে সচেতন করা এবং যারা ধর্মের নাম বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে তাদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা।’
এইউএ/এমএআর//