জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে অন্তত ৭৫টি অননুমোদিত সংগঠনের নাম পাওয়া গেছে। এ সব সংগঠনের আয়োজিত সভায় অংশ নিতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের অন্তত ডজনখানেক কেন্দ্রীয় নেতা ও দলের মন্ত্রী-এমপিদের।

নাম সর্বস্ব ও প্যাড নির্ভর এসব সংগঠনের সভায় অংশ নিয়ে মূল দলের পদ বাগিয়ে নেওয়ারও নজির রয়েছে। কিন্তু যখনই এ সব সংগঠন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে তার দায়ভার নিতে অস্বীকৃতি জানায় আওয়ামী লীগ।

সাম্প্রতিক সময়ে ‘আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামে একটি সংঠনের পোস্টার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হেলেনা জাহাঙ্গীর আর সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মনির। পোস্টারে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক হিসেবে সাইফুল ইসলাম ইমনের ফোন নম্বর দিয়ে তাতে পদ প্রত্যাশীদের যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল। ওই পোস্টারে সংগঠনটির জেলা, উপজেলা ও বিদেশি শাখায় সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক নিয়োগ হবে বলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।

এ ঘটনার পর সমালোচনার মুখে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় হেলেনা জাহাঙ্গীরকে। 

এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দলের গঠনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগের রয়েছে সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং বিভিন্ন উপকমিটি। স্বীকৃত সংগঠনের বাইরে যে কোনো নামের সঙ্গে ‘লীগ’ বা ‘আওয়ামী’ শব্দ জুড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।  

তিনি বলেন, দল ক্ষমতায় থাকলে নানান সুবিধাভোগী শ্রেণি এবং বসন্তের কোকিলরা এ ধরনের চেষ্টায় লিপ্ত হয়। যুক্ত হয় নানান আগাছা-পরগাছা। দলীয় সভানেত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী দলের মধ্যে কারও প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে এ ধরনের কাজে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, লীগ নাম ব্যবহার করে যারা এসব সংগঠন করে বেড়াচ্ছেন তারা প্রতারক। এসব প্রতারকদের বিরুদ্ধে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

তিনি বলেন, এর আগে সারাদেশে আমরা আড়াইশ প্রতারক সংগঠনের তালিকা করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। কিছুদিন এ প্রতারক শ্রেণির তৎপরতা বন্ধ ছিল। এখন আবার শুরু হয়েছে। তাদের চিহ্নিত করে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, সরল বিশ্বাসে বা অতি জনপ্রিয়তা প্রমাণ করতে বড় নেতাদের যত্রতত্র যার তার সঙ্গে সেলফি বা ফটো তোলা এবং যেন-তেন প্রোগ্রামে যাওয়া দলের জন্য মর্যাদা হানিকর...।  

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই ধরনের সংগঠনের আয়োজনে বিভিন্ন আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হতেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি তখন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। প্রধান অতিথি হতেন দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম ও অ্যাডভোকেট প্রয়াত সাহারা খাতুন বিভিন্ন আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নিতে। 

সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী এবং অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট তারানা হালিম, আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম- এসব নেতাদের নামসর্বস্ব বিভিন্ন সংগঠনের আয়োজিত আলোচনা সভায় যোগ দিতে দেখা যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু একাডেমি নামে সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলেন চিত্ত রঞ্জন দাস। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তা দিয়েই বাগিয়ে নিয়েছেন সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ। পাশাপাশি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন চিত্ত রঞ্জন দাস। 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে সজিব ওয়াজেদ জয় লীগের ঢাকা জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল বারেক ও আহ্বায়ক রনি আহমেদের বড় ভাই খোরশেদ আলম আটক করা হয়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু একাডেমি নামে সংগঠনের বিভিন্ন আয়োজনে উপস্থিত থাকেন কৃষক লীগ নেতা পরিচয় দেওয়া এম এ করিম আটক হয়েছিলেন অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগে। 

অনুসন্ধানে পাওয়া যাওয়া- অননুমোদিত সংগঠনের মধ্যে রয়েছে: ১. জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ, ২. জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় সংসদ, ৩. আওয়ামী প্রচার লীগ, ৪. আওয়ামী সমবায় লীগ, ৫. আওয়ামী তৃণমূল লীগ, ৬. আওয়ামী ছিন্নমূল হকার্স লীগ, ৭. আওয়ামী মোটরচালক লীগ, ৮. আওয়ামী তরুণ লীগ, ৯. আওয়ামী রিকশা মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ, ১০. আওয়ামী যুব হকার্স লীগ, ১১. আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, ১২. আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, ১৩. আওয়ামী পরিবহন শ্রমিক লীগ, ১৪. আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, ১৫. আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, ১৬. আওয়ামী যুব সাংস্কৃতিক জোট, ১৭. বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা গবেষণা পরিষদ, ১৮. বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, ১৯. বঙ্গবন্ধু একাডেমি, ২০. বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, ২১. বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, ২২. ওলামা লীগ, ২৩. বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, ২৪. বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, ২৫. বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, ২৬. বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ, ২৭. বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, ২৮. বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ, ২৯. বঙ্গবন্ধু আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন, ৩০. বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, ৩১. বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পরিষদ, ৩২. বঙ্গবন্ধু গ্রাম ডাক্তার পরিষদ, ৩৩. বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, ৩৪. বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, ৩৫. বঙ্গবন্ধু আদর্শ পরিষদ, ৩৬. বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ৩৭. আমরা মুজিব সেনা, ৩৮. আমরা মুজিব হব, ৩৯. চেতনায় মুজিব, ৪০. বঙ্গবন্ধুর সৈনিক লীগ, ৪১. মুক্তিযোদ্ধা তরুণ লীগ, ৪২. নৌকার সমর্থক গোষ্ঠী, ৪৩. দেশীয় চিকিৎসক লীগ, ৪৪. ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ, ৪৫. ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ, ৪৬. নৌকার নতুন প্রজন্ম, ৪৭. ডিজিটাল ছাত্রলীগ, ৪৮. ডিজিটাল আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, ৪৯. ডিজিটাল আওয়ামী ওলামা লীগ, ৫০. বাংলাদেশ আওয়ামী পর্যটন লীগ, ৫১. ঠিকানা বাংলাদেশ, ৫২. জনতার প্রত্যাশা, ৫৩. রাসেল মেমোরিয়াল একাডেমি, ৫৪. জননেত্রী পরিষদ, ৫৫. দেশরত্ন পরিষদ, ৫৬. বঙ্গমাতা পরিষদ, ৫৭. বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিষদ, ৫৮. আমরা নৌকার প্রজন্ম, ৫৯. আওয়ামী শিশু যুবক সাংস্কৃতিক জোট, ৬০. তৃণমূল লীগ, ৬১. একুশে আগস্ট ঘাতক নির্মূল কমিটি, ৬২. আওয়ামী প্রচার লীগ, ৬৩. সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ, ৬৪. বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি লীগ, ৬৫. আওয়ামী শিশু লীগ, ৬৬. আওয়ামী তরুণ প্রজন্ম লীগ, ৬৭. আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ, ৬৮. বাংলাদেশ জনসেবা লীগ, ৬৯. আওয়ামী শিশু-কিশোর লীগ, ৭০ অভিভাবক লীগ, ৭১ উদ্যোক্তা লীগ, ৭২. আওয়ামী অনলাইন লীগ, ৭৩. বিশ্ব আওয়ামী অনলাইন লীগ, ৭৪. জনসেবা লীগ এবং ৭৫. আল্লাহ ওয়ালা লীগ।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হলো ১০টি। সহযোগী আটটি সংগঠন হলো মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, তাঁতী লীগ, যুব মহিলা লীগ, মৎস্যজীবী লীগ। আর ভ্রাতৃপ্রতিম ২টি সংগঠন হলো জাতীয় শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ। এছাড়া অঙ্গ সংগঠন হিসেবে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিব), মহিলা শ্রমিক লীগকে ওন করে আওয়ামী লীগ।

বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কারো নামে কোনো সংগঠন করতে হলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ থেকে অনুমোদন নিতে হয়ে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ট্রাস্টের কোনো নিয়ম-নীতির কথা উল্লেখ না থাকায় এর দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগকে। 

‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ এখন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের নামে ১৭৮ রাস্তা ও ব্রিজ কালভার্ট, বিদ্যালয়সহ (উন্নয়ন প্রকল্প) প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টে সংগঠন অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে নিদিষ্ট কোনো নিয়ম-নীতি না থাকায় এখানে থেকে কাউকে সংগঠন করার ক্ষেত্রে অনুমোদন দেওয়া হয় না। তবে এখন পর্যন্ত  বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের অফিসে দুটি সংগঠন অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছেন। সংগঠনগুলো হলো বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক একাডেমি ও বঙ্গবন্ধু লীগ।

এইউএ/এসএম