ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১ ধারা অনুযায়ী খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য অনুমতি দেওয়ার সুযোগ নেই— সরকারের পক্ষ থেকে এমনটি বলা হয়েছে। তারপরও বিএনপির পক্ষ থেকে দলীয় প্রধানের বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বারবার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। দলটির নেতারা বলছেন, ‘অনুমতি না দিলেও তারা সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়ে যাবেন। হয়তো একদিন সরকার অনুমতি দেবে’— এমন প্রত্যাশায় আছেন তারা।
 
বিএনপির নেতারা বলছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে খুবই অসুস্থ। বিষয়টি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরকার ঠিকই জানতে পারছে। তারপরও কেন তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে না, একটি ঘরে ‘বন্দি’ রাখা হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এখানে অন্য একটি পক্ষের হস্তক্ষেপ রয়েছে!
 
কারা সেই পক্ষ— বিষয়টি পরিষ্কার না করলেও বিএনপির নেতারা বলছেন, তারা (অপরপক্ষ) চায় না দেশের বর্তমান এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া বাইরে যাক। আমরাও হাল ছাড়ছি না। সরকার যতই না করুক, আমরা বারবার তাগাদা দিয়ে যাব। 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে খুবই অসুস্থ। বিষয়টি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরকার ঠিকই জানতে পারছে। তারপরও কেন তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে না, একটি ঘরে ‘বন্দি’ রাখা হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এখানে অন্য একটি পক্ষের হস্তক্ষেপ রয়েছে 

দীর্ঘ ৫৩ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে গত ১৯ জুন রাতে বাসভবন ফিরোজায় ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এখন তাকে বাসায় রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার সময় যেমন ছিলেন এখন তেমনই আছেন। অর্থাৎ তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। আগের তুলনায় তার অবস্থার উন্নতি বা অবনতি কোনোটাই হয়নি। বর্তমানে তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলেও হার্ট, কিডনি ও লিভারের সমস্যা আগের মতোই আছে।
 
গত ২ জুলাই খালেদা জিয়ার চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। ওই সময় তারা বলেন, গুলশানের বাসভবন ফিরোজাকে একটি মিনি হাসপাতালে রূপ দেওয়া হয়েছে। সেখানে অক্সিজেন সাপোর্টসহ প্রাথমিকভাবে সবধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কারণ, প্রতিদিনই তার কোনো না কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হচ্ছে। যাতে তার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা কী, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়।
 
এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার চিকিৎসক ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ম্যাডামের অবস্থা আগের মতোই আছে। অর্থাৎ তিনি হাসপাতাল থেকে যেমন এসেছিলেন, তেমনই আছেন। কোনো পরিবর্তন নেই। এখন বিদেশে নিয়ে গেলে তার সুষ্ঠু চিকিৎসা সম্ভব— মত দেন তিনি। 

কিন্তু বিদেশে চিকিৎসার জন্য প্রথমে সরকারের অনুমতি প্রয়োজন। সরকার তো অনুমতি দিচ্ছে না— এমনটি উল্লেখ করে খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা বারবার সরকারকে অনুমতি দিতে অনুরোধ করেছি। কিন্তু সরকার অনুমতি দিচ্ছে না। দেখি, শেষপর্যন্ত কী হয়!’
 
সরকার কেন অনুমতি দিচ্ছে না— এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে মানুষের জামিন পাওয়া অধিকার আছে। ম্যাডামও সেই অধিকার রাখেন। সেখানে বলা আছে বয়সের কথা, তিনি ৭৬ বছরের বয়স্ক একজন মানুষ। সেখানে মহিলাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা আছে, ম্যাডাম একজন মহিলা। সেখানে সামাজিক অবস্থানের কথা বলা আছে। ম্যাডাম সাবেক প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সরকার তাকে ৪০১ ধারা দেখিয়ে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে না। এটা অমানবিক।’
 
খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে সংসদে আইনমন্ত্রী (আনিসুল হক) যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশের আইনে তিনি সুবিচার পাবেন না’— বলেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তিনি আরও বলেন, ‘ম্যাডামের চিকিৎসার বিষয়টি তাদের (সরকারের) রাজনীতির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। তারা দিনদিন ম্যাডামকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ম্যাডাম খালেদা জিয়ার যদি কিছু হয় এর দায়দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।’  
 
গত ১ জুলাই সংসদে হারুনুর রশীদ এমপির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই। এর বাইরে আইনের অন্য কোনো বিধান দেখাতে পারলে এ পেশা ছেড়ে দেব।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এখন একটাই কাজ। সেটি হচ্ছে সরকারকে বারবার তাগাদা দেওয়া। তাগাদা দিতে দিতে প্রধানমন্ত্রীও (শেখ হাসিনা) দেখবেন যে দেশের অবস্থা খারাপ, কখন কী হয়; তখন হয়তো একদিন তাকে (খালেদা জিয়া) বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেবেন।
 
ওই নেতা আরও বলেন, তাকে জেলে রেখে তো সরকারের কোনো লাভ নেই। বরং চিকিৎসার জন্য তাকে বাইরে পাঠিয়ে দিলে প্রধানমন্ত্রী  মানুষের সহানুভূতি পাবেন। আর প্রধানমন্ত্রী মানুষ হিসেবে খারাপ নন। আমরা আশা করি তিনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) তাকে (খালেদা জিয়া) বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেবেন। 


 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত এক চিকিৎসক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা কেমন, সে বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর ও তথ্য সংগ্রহ করেন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোকজন। সেই রিপোর্ট প্রতিদিনই সরকারের উচ্চ মহলের যাচ্ছে। ফলে ম্যাডামের বর্তমান শারীরিক অবস্থা যে ভালো নয়, তা সরকার ভালো মতোই জানে। 

তিনি (খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক) আরও বলেন, বর্তমানে বাসায় রেখে ম্যাডামকে যতটুকু চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব, আমরা সে চেষ্টাই করে যাচ্ছি। পরিপূর্ণভাবে চিকিৎসা দিতে তাকে দেশের বাইরে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। কারণ, তার হার্ট, কিডনি, লিভারের অবস্থা ভালো না। পুরাতন জটিল কিছু সমস্যা তো আছেই।
 
খালেদা জিয়ার বাসভবনে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা
 
এদিকে, বর্তমান করোনা মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তি সতর্কতার অংশ হিসেবে খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার চিকিৎসক এবং বাসভবনের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের বাইরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি বাইরে থেকে কোনো খাবারও ভেতরে নিতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে তার পরিবারের সদস্যরা দেখা কিংবা রান্না করা খাবার পাঠাতে পারছেন না। 


 
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিকিৎসকদের নিষেধাজ্ঞার কারণে আমরা কেউ তার (খালেদা জিয়ার) সঙ্গে দেখা করতে যাই না। আগে তার জন্য আমরা রান্না করে খাবার পাঠাতাম। এখন সেটাও পাঠাতে পারি না। ফিরোজায় সব রান্নাবান্না হয়।
 
গত ১১ এপ্রিল গুলশানের বাসা ফিরোজায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন খালেদা জিয়া। ২৭ এপ্রিল তিনি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে ৩ মে শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে তাকে সিসিইউতে (করোনারি কেয়ার ইউনিট) স্থানান্তর করা হয়। ৯ মে করোনামুক্ত হন বিএনপি চেয়ারপারসন।
 
দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছর দণ্ডিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দুই বছরের বেশি সময় কারাভোগের পর করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে গত বছর ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পান। ছয় মাস পর তার মুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চে তার সাময়িক মুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়।
 
এএইচআর/এমএআর/