আওয়ামী লীগকে গোখরা সাপের সঙ্গে তুলনা করে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছেন, গণতান্ত্রিক অধিকার সবাই ভোগ করবেন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির রাজনীতিতে সবাই অংশ নিতে পারবেন। এতে কোনো আপত্তি ওনই। কিন্তু এই সবাই কারা? ফ্যাসিবাদ ও গণতন্ত্র কি একই জিনিস? আমরা যাদের (আওয়ামী লীগ) ফ্যাসিবাদ হিসেবে পরাজিত করেছি, তারাও তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্র বলে আসতে চাইতে পারে।

আওয়ামী লীগ কখনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বা শক্তি ছিল না উল্লেখ করে তাহের বলেন, ‘গোখরা সাপের সঙ্গে এক বিছানা শেয়ার করা গণতন্ত্র না। কারণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের (আওয়ামী লীগ) এক বিছানায় জায়গা দিলেন, ঘুমের ভেতরে আপনাকে কামড়ে দিল, তাহলে সেই রাইট কি অ্যালাউ করা যায়?’

সোমবার (২১ অক্টোবর) সেগুনবাগিচায় বিএমএ ভবনের শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলন সভাকক্ষে প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে একথা বলেন তিনি।

তাহের বলেন, আওয়ামী লীগ যখন স্বাধীনতার পরে ক্ষমতায় ছিল তখন তো নিজেরাই বাকশাল কায়েম করেছে। নিজেরাই নিজেদের নিষিদ্ধ বা অনুপযুক্ত করেছে। বাকশাল তো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিষয় না। আওয়ামী লীগ যদি গণতান্ত্রিক দলই না হয় তাহলে তারা গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশ নিতে ফিরতে পারবে না।

তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে তারা কি করেছে এটা নতুন করে ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন আর নেই। কারণ এটা সবাই জানে। শুধু আওয়ামী লীগের বাইরের মানুষ নয়, আওয়ামী লীগেরও একটা অংশে আওয়ামী ফ্যাসিবাদে ভুগেছে। গণতন্ত্র তো তাদের জন্য যারা গণতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তারাই আসবে যারা নিজেরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, দেশটাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চালাতে চায়। আওয়ামী লীগ যদি গণতান্ত্রিক দলই না হয় তাহলে তারা গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশ নিতে ফিরতে পারবে না। এটা পিআর পদ্ধতিতে হোক কিংবা আগের পদ্ধতিতে হোক, যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন পারবে না। এটা স্পষ্ট কথা।

দুয়েকটি দল বাদে সব দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থার পক্ষে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কারা ক্ষমতায় যাবে তা তো স্পষ্ট নয়। দলীয় সরকার যখন হবে, সেই সরকার তার নিজের স্বার্থের ব্যাপারে বেশি করে মনোযোগী হবে তখন হয়ত পিআর পদ্ধতি নিজেদের জন্য উপযুক্ত নাও মনে করতে পারে। তারা এজেন্ডায় পিআর বিষয়টি হয়ত আনবেন না। যারা পিআর পদ্ধতি চাইছেন তাদের ইনভাইট নাও করতে পারেন। সেজন্য এটাই উপযুক্ত সময়।

‘আমরা যদি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন নাও করি, পরাজিত ফ্যাসিবাদ কি নির্বাচনে অংশ নেবে? নেওয়া উচিত? এটা প্রশ্ন। আমরা যদি পিআর পদ্ধতিতে তাদের সুযোগ নাও দিই, নির্বাচন হলে বা তারা অংশ নিলে তো তারা ৮/১০টা আসনে পেতেই পারে। তাহলে কি হবে? আমাদের আসলে ভিন্ন উপায়ে তা সমাধান করতে হবে।’

আমাদের সার্বিক মূল্যায়ন হচ্ছে, আমরা দেখেছি, গণতন্ত্রে, অর্থনীতিসহ অন্য সব কিছুতে তারা (আওয়ামী লীগ) নিজেদের হিংস্র শক্তি হিসেবে প্রমাণ করেছে। এজন্য আমাদের স্ট্যান্ড হচ্ছে, আওয়ামী লীগ যেহেতু গণতান্ত্রিক নয়, সুতরাং তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই।

এই সুযোগটি রহিত করার আইনগতভাবে দায়িত্ব এই কেয়ারটেকার সরকারের। এই সরকারের শক্তিটা কি? তাদের তো কোনো দল নেই। তাদের শক্তি হচ্ছে সব ধরনের জনগণ, অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট সব রাজনৈতিক দলের, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, দুর্নীতি বিরোধী, স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিস্ট শাসন বিরোধী ফসল তারা।

আমরা আন্দোলনে মরলাম কেন? তা স্পষ্ট করতে হবে এই সরকারকেই। কারণ ওটাই তো এই সরকারের স্পিরিট। স্টেকহোল্ডার তো তারা, যারা রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে, ইজ্জত দিয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে তারা। আর এটা শুধু এই জুলাই-আগস্ট ইস্যুতে নয়। পাটাতন তৈরি করা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। আওয়ামী লীগ চারটা জেনোসাইড করেছে।

তাহের সমালোচনা করে বলেন, কিছু বুদ্ধিজীবী আছে যারা জঘন্য ফ্যাসিস্ট। তারা এমনভাব দেখাতে যায়, যেন তিনি বিশাল কিছু বোঝেন। আসলে তিনি কিছুই বোঝেন না। কোনো জ্ঞান যদি মানবতা, গণতন্ত্র বা মনুষ্যত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়, তাহলে সে জ্ঞান কোনো জ্ঞানই নয়। তিনি তাদের বুদ্ধিজীবী না বলে বুদ্ধির বেকারি বলে অভিহিত করেন।

সবার অধিকারের কথা বলে যারা কথা বলেন, তাদের প্রতি পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, কার অধিকার? আমাকে যে খুন করেছে, আমার পিতাকে, সন্তানকে যে খুন করেছে তার অধিকার কি আমার সমান? তাহলে খুনি হত্যাকারীর বিচার কে করবে? যেভাবে দেশে লুট হয়েছে তা লক্ষ কোটি হাজারে ছাড়িয়ে উচ্চারণের বাইরে চলে গেছে। দুঃখ লাগে আমরা কি স্বাধীন রাষ্ট্র, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অর্জন শেষ হয় না। ইন্ডিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন একবার স্বাধীন হয়েছে তারা স্বাধীনতা কনটিনিউ করছে আমরা পারছি না কেন? আমরা একবার ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়েছি কিন্তু কনটিনিউ করতে পারি নাই, ১৯৭১ সালে আরেকটা স্বাধীনতা অর্জন করেছি সেটাও কনটিনিউ করতে পারি নাই। আমরা ২০২৪ সালে আগস্টে এসে বলছি আবার স্বাধীন হয়েছি। কেন বলছি? কেন হয়? আমাদের কি আরও স্বাধীনতা লাগবে? আমরা স্বাধীনতাকে আসলে পরিপূর্ণ করতে চাই। এজন্য আমাদের দরকার একটি পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব। এটা গণঅভ্যুত্থান ছিল, বিপ্লব ছিল না। বিপ্লব মানে হচ্ছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সবক্ষেত্রে পরিবর্তিত হবে। আমাদের সেই বিপ্লব করতে হলে আগে নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে। আমি নিজে চাঁদাবাজি, জবরদখল করবো আর রাস্তায় এসে গণতন্ত্রের পক্ষে স্লোগান দেব তা হবে না। এখানে আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্থিতাবস্থার জন্য আমাদের আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন অবশ্যই দরকার। তাতে দেশে আর কেউ স্বৈরাচার হতে পারবে না। অনেকে বলেন এটা তো ঝুলন্ত সরকার হবে। ৪২ টা দেশে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা আছে। কই সেখানে তো ব্যাংকিং সরকার হয়নি। আমি নরওয়ে সুইডেনের অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে বৈঠকে গিয়েছিলাম। বোঝার জন্য গিয়েছিলাম। তাদের সেখানেও সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন হয়।

আর এখানে ৪৯ শতাংশ পেলেও ফেল, জিরো। এখানে যারা হাজির হয়েছেন, তারা আজকের প্রেক্ষাপটে নির্বাচন হলেও একটা আসনও পাবেন না। কিন্তু যদি সংখ্যানুপাতিক হার পদ্ধতিতে নির্বাচন হয় তাহলে একটা হলেও তো আসন পাবেন। যদি নানা চিন্তা-মতের রাজনৈতিক দল মিলে পার্লামেন্ট হয় তাহলে মৌলিক পরিবর্তনগুলো সম্ভব।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম পীর সাহেব চরমোনাইর আহ্বানে গোলটেবিল বৈঠকে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা বক্তব্য রাখেন।

জেইউ/জেডএস