ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস পূর্ণ হয়েছে আজ। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিএনপির চাওয়া-পাওয়া ও প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু প্রথম দুই মাসে সরকারের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের চাওয়ার-পাওয়ার হিসাব মেলেনি বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।

এ বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে। তবে, শেখ হাসিনার পলায়ন এবং ড.ইউনূসের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা নির্ভয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছে বলে খুশি বিএনপি।

দলটির নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের জীবন দুর্বিষহ ছিল। বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা সবসময় গুম-খুন ও হামলা-মামলার আতঙ্কে ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সেই আতঙ্ক ও দুঃস্বপ্ন থেকে সাধারণ মানুষ, বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী ও গণতন্ত্রকামী মানুষ স্বস্তি পেয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‌‘বর্তমান সরকারের ২ মাস নিয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। তারা ক্ষমতা নেওয়ার সময় যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাতে আমরা খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এ ২ মাসে যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করার দরকার ছিল সেগুলো গ্রহণ করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার।’

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর মূল্যায়ন হলো, বিগত সরকারের ১৫-১৬ বছরের শাসনামলের যে বিরাজমান আতঙ্ক, দুঃস্বপ্ন, সেখান থেকে মানুষ মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে।

রিজভী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ২ মাসে এটুকু বলা যায় যে, শেখ হাসিনার সময়ে যে বিরাজমান আতঙ্ক, দুঃস্বপ্ন ছিল সেখান থেকে সাধারণ মানুষ, বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী ও গণতন্ত্রকামী মানুষ মুক্তি পেয়েছে। তারা এখন মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে। শঙ্কাহীন ভাবে চলাফেরা করতে পারছে। এটা একটা বড় ডেভেলপমেন্ট।’

অন্তর্বর্তী সরকারের এই দুই মাসে প্রশাসনিক নিয়োগ, রদবদল এবং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের নামে থাকা ‘রাজনৈতিক’ মামলা প্রত্যাহার না করা নিয়ে ‘অসন্তোষ’ আছে বিএনপিতে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, ড.ইউনূস নিজেই বলেছেন, রাষ্ট্র ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে গিয়ে শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা এই দুই মাসে প্রশাসনে শেখ হাসিনার সেই সহযোগীদের এখনো বহাল রেখেছেন। এছাড়া খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিলেও তার নামে থাকা মামলাগুলো এখনো প্রত্যাহার করেনি। একইসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বললেও আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা কী, সেটা প্রকাশ করেনি জাতির সামনে। এসব কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিএনপির শীর্ষ মহলে কিছুটা হতাশা ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ও চাওয়া হচ্ছে, এই সরকার যা-যা ওয়াদা করেছে এবং জনগণের কাছে যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা অতি দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেছেন যে, শেখ হাসিনা দেশের বিভিন্ন সেক্টরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এটাকে সংস্কার করতে হবে। কিন্তু সেই সংস্কারে এখন পর্যন্ত তাদের তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই বলে মনে করি।’

গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতে রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এসেছেন বলেও জানান মোশাররফ। তিনি বলেন, ‘সাক্ষাতে আমরা বলে এসেছি সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়া হোক। সংস্কারের কথা বললে তো হবে না, তা বাস্তবায়নের রোডম্যাপ দিতে হবে।’

রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘এই সরকার গণতন্ত্রের পথে হেঁটে যাওয়ার ক্ষেত্রে কতটুকু পদক্ষেপ নিচ্ছে, কতটুকু দক্ষতা এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছে তা নিয়ে মন্তব্য করতে আরও ২-১ মাস সময় লাগবে। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে, প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করার ক্ষেত্রে তারা কতটুকু সময় নিচ্ছে, সেটা দেখতে হবে। তাদের পদক্ষেপগুলো দেখতে হবে। তখন আমরা বুঝতে পারব তারা কতটুকু অগ্রসর হচ্ছেন। তাদের দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে। বেশি সময় নিলে হবে না।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই খালেদা জিয়াসহ দলের অন্যান্য নেতাদের নামে হওয়া রাজনৈতিক মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু সেটা নিয়ে একটা কমিশন গঠন হলেও মামলা প্রত্যাহার হয়নি। যেটা রাজনৈতিভাবে বিএনপির জন্য শুভ লক্ষণ নয়।’

এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেছিলেন, এই সরকারের মধ্যে দুই-একজন আছেন, যারা বিপ্লব, গণ-অভ্যুত্থানের যে মূল স্পিরিট, সেটি ব্যাহত করছেন। আমরা তাদের সরানোর কথা বলেছি। এখনো বিগত সরকারের দোসর কিছু আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তা রয়ে গেছেন। গণহত্যার তথ্য অনুসন্ধানে বাংলাদেশে আসা জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলকে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা সহযোগিতা করছেন না।’

এএইচআর/এসকেডি