বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। গত ৫ আগস্ট দলের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। এরপর থেকে দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা, বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘মব’ জাস্টিসের নামে পিটিয়ে হত্যা বা আহত করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ক্ষমতা থাকা দলটির নেতাকর্মীদের। অনেকের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে, হচ্ছে লুটপাট।

সরকার পতনের পর থেকে যেসব নেতাকর্মী নিহত বা আহত হয়েছেন, যাদের বাড়িঘর ভাঙচুর কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়েছে, সেই সব নেতাদের তালিকা করবে আওয়ামী লীগ। টানা ১৫ বছরের অধিক সময় ক্ষমতায় থাকা দলটির শীর্ষপর্যায়ের একাধিক নেতা ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

সরকার পতনের পর থেকে যেসব নেতাকর্মী নিহত বা আহত হয়েছেন, যাদের বাড়িঘর ভাঙচুর কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়েছে, সেই সব নেতাদের তালিকা করবে আওয়ামী লীগ। টানা ১৫ বছরের অধিক সময় ক্ষমতায় থাকা দলটির শীর্ষপর্যায়ের একাধিক নেতা ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমাদের চেষ্টা চলছে। আমরা বিভিন্নভাবে বলেছি এবং এখনও বলি, সারা দেশে অসংখ্য নেতাকর্মী ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। সেই তালিকা আমাদের নেতাকর্মীরা প্রণয়ন করছেন। অনেকের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর তালিকা ও মামলা করার কথা বলা হয়েছে।’

‘তারপরও অভিযোগ আসছে। থানা মামলা নিচ্ছে না, জিডি নিচ্ছে না, কোনো কিছুই হচ্ছে না। কারণ, যারা নেবেন তারা তো মানসিকভাবে প্রস্তুত না। তাদের সেই মানসিক অবস্থা নেই। এখন তারা সেগুলোর প্রতি আগ্রহ বা প্রয়োজন দেখাচ্ছেন না। আমারও মনে করি, যতটুকু সম্ভব জিডি করা বা কোর্টের আশ্রয় নেওয়া। তা না পারলে তালিকা করা। এগুলো দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দলের নেতাকর্মীরা কাজ শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের তো এগুলো দরকার। দলের কাছে হিসাব থাকবে, পরিসংখ্যান থাকবে। সেই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে আমরা আমাদের নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। দলের এ দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের কষ্ট ও দুঃখ আমরা শেয়ার করতে চাচ্ছি। তাদের পাশে আর্থিকভাবে দাঁড়াতে না পারলেও মানসিকভাবে থাকতে চাচ্ছি। আমাদের আন্তরিকতা, ভালোবাসা, মায়া বা মমতা দিয়ে; আমরা আমাদের নেতাকর্মীদের আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছি।’

দলীয় সূত্র মতে, আওয়ামী লীগ ‘মান্থলং স্টেট-স্পন্সরড প্রোগ্রাম টু ডিসিমেট আওয়ামী লীগ’ শীর্ষক একটি ভিজ্যুয়াল ডকুমেন্ট তৈরি করেছে। যা জাতিসংঘ, দূতাবাস, হাইকমিশন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোতে পাঠানো হয়েছে। সেখানে গত মাসে (আগস্ট) আওয়ামী লীগের নেতা, সদস্য ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে চালানো সহিংস ঘটনা এবং দমন-পীড়নের সচিত্র প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে।

নথিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জামায়াতে ইসলামী বিরোধী দল, মত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সমন্বিতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধগুলো আমরা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আপনারা গুরুত্বসহকারে বিষয়টি অনুধাবন করবেন এবং এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’

নথিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানো এবং হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এমনকি হত্যা ও বাসস্থান লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের দায়মুক্তি দেওয়ার তথ্যও বলা হয়েছে।

এদিকে, গত ৫ আগস্ট থেকে আওয়ামী লীগের কোনো কেন্দ্রীয় নেতা বা দপ্তর সম্পাদককে গণমাধ্যমে কোনো ধরনের বক্তৃতা বা বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দলের ভেরিফাইড পেজ থেকে সব ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য নেতাকর্মীদের বলা হয়েছে। দলীয় সব তথ্য ফেসবুক পেজ, ইউটিউব ও টেলিগ্রাম চ্যানেলে দেওয়ার বিষয়টিও জানানো হয়েছে। এরপর থেকে দলটির সব তথ্য অনলাইন মাধ্যমগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে। সেখান থেকে নেতাকর্মীদের নির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত সবাই তাদের পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে নিকটস্থ সেনাক্যাম্পে গিয়ে লিখিত অভিযোগ জানান। সেখানে বলা হয়, ‘আমরা সারা দেশ থেকে খবর পেয়েছি যে, বেশির ভাগ থানাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাটের বিষয়ে সাধারণ ডায়েরিও করতে দেওয়া হচ্ছে না। যেহেতু সেনাবাহিনীকে মেজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাই অপরাধীদের থামাতে এখন সেনাবাহিনীর কাছেই অভিযোগ দেওয়ার বিকল্প নেই। ক্ষতিগ্রস্ত সবাই, তাদের পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে নিকটস্থ সেনা ক্যাম্পে লিখিত অভিযোগ এবং সন্ত্রাসীদের নাম উল্লেখ করে জমা দিন।’

আরেক পোস্টে বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা থানায় লিখিত অভিযোগ আকারে জমা দেওয়ার জরুরি নির্দেশনা দেওয়া হলো।’ এতে আরও বলা হয়, ‘জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুসন্ধান দল এখন বাংলাদেশে। তারা ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করবে এবং গোপনীয়তা রক্ষা করবে।’

অন্য এক পোস্টে বলা হয়, ‘এ সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দুস্থ কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো। তৃণমূলের প্রায় ৫০ হাজার কর্মী ই-মেইল ও মেসেজের মাধ্যমে তাদের করুণ অবস্থার কথা জানিয়েছেন। বিশেষ করে অনুরোধ করেছেন তাদের পরিবারগুলোকে বাঁচাতে। অনেকেই মামলা-হামলা ও গ্রেপ্তারের কারণে বাড়িতেও অবস্থান করতে পারছেন না। দেশে বা প্রবাসে থেকে যারা দুস্থ নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়াতে চান, তারা ই-মেইল বা হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করবেন। আপনার কাছে আমরা তথ্য সরবরাহ করব।’

অসহায় কর্মীদের যারা সহায়তা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অপর এক পোস্টে বলা হয়, ‘দেশে বা প্রবাসে থেকে যারা নিজ নিজ এলাকার কর্মীদের সহযোগিতা করছেন, তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। আমরা এখন থেকে পাবলিক প্লাটফর্মে কারও ব্যক্তিগত ফোন নম্বর বা অন্য যে কোনো পরিচিতি শেয়ার করা থেকে বিরত থাকব।’

আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের এবং তাদের পরিবারের প্রতি জরুরি নির্দেশনা জানিয়ে আরও বলা হয়, ‘আপনার বা আপনার পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার বিবরণ লিখে থানায় অভিযোগ দিন। অভিযোগ না নিতে চাইলে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করুন। যদি সাধারণ ডায়েরিও করতে না দেয়, আমরা জাতিসংঘের তদন্ত দলের কাছে দলীয়ভাবে অভিযোগ দেব।’

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক কার্যনির্বাহী সদস্য আত্মগোপন থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সারা দেশ থেকে অনলাইনে জুলাই ও আগস্ট মাস এবং চলতি সেপ্টেম্বর মাসেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি। এটি এখনও চলমান। দেশের প্রতিটি জেলা, মহানগর, উপজেলা, ইউনিয়ন, এমনকি ওয়ার্ড পর্যায় থেকেও আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। প্রতিটি জায়গায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও মিথ্যা মামলা দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। অথচ আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেওয়া হচ্ছে একাধিক মিথ্যা মামলা।’

তিনি অস্থির এ সময়ে দলীয় নেতাকর্মীদের আরও বেশি ধৈর্য ও সহনশীল হওয়ার পরামর্শ দেন।

এমএসআই/পিএইচ