১৯৪৯ থেকে ২০২৪, দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে ওঠা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি আজ স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতার আসনে বসে রাজত্ব করছে টানা দেড় দশক।

প্রতিষ্ঠার পর ৭৫ বছর পার করেছে ঐতিহ্যবাহী দলটি। স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দেওয়ার পর ইতোমধ্যে ২৪ বছর দেশ শাসন করেছে আ.লীগ। এ বছর টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় বসেছে পঁচাত্তরের পর শেখ হাসিনার হাত ধরে ঘুরে দাঁড়ানো দলটি।

এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকায় দেশ ও দল দুটিই লাভবান হয়েছে বেলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। তবে ক্ষমতার সংস্পর্শে থাকার সময়গুলোতে দলের মধ্যে সত্যিকার অর্থে কারা সুফল ভোগ করেছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে তাদের। 

পঁচাত্তরের পর ২১ বছর এবং পরে আরও ৫ বছর যখন ক্ষমতার বাইরে ছিল তখন যারা দলটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তারা যথাযথ মূল্যায়ন পেয়েছেন কি না তা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা আলোচনা আছে। অনেকে মনে করেন দুঃসময়ের বহু নেতাকর্মী সুসময়ে উপযুক্ত সম্মান পাননি।

জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে মনে করছেন বর্তমানে দলের মধ্যে ব্যবসায়ী, সরকারি আমলা, হাইব্রিড নেতা, ভুঁইফোঁড় সংগঠনের নেতা বা পরিবার কেন্দ্রিক ক্ষমতাবান তৈরি হয়েছে। রাজনীতিতে সক্রিয় কর্মী বা নেতার চেয়ে তারাই বেশি লাভবান হচ্ছে। 

আওয়ামী লীগের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আওয়ামী লীগ দীর্ঘ পঁচাত্তর বছর দেশ ও দেশের মানুষের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে এবং উন্নয়নের জন্য লড়েছে। বারবার ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়ার পরও টানা চারবার ক্ষমতায় রয়েছে। যখনই ষড়যন্ত্র হয়েছে তখনই মাঠে দলের নেতাকর্মীরা সক্রিয় ছিল। তবে ক্ষমতায় আসার পর দলের নেতাকর্মীদের চেয়ে ব্যবসায়ী ও সরকারি আমলারা ক্ষমতার সুফল ভোগ করেছে বেশি। মাঠের নেতাকর্মীরা মূল্যায়নে সবসময় পিছিয়ে ছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, বর্তমানে দুর্নীতির বিষয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। গ্রামের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদেও দুর্নীতির বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। সেখানে যাদের নাম আসছে তারা কেউ রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত নন। তারা নিজেদের স্বার্থে দলের নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতার উঁচু স্থানে গেছেন এবং ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে দুর্নীতি করেছেন। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। অথচ দলকে ক্ষমতায় আনতে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা। ‘ক্ষমতার যুগে’ নেতাকর্মীদের চেয়ে ব্যবসায়ী ও আমলারাই লাভবান হয়েছে বেশি। শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতাতেও ব্যবসায়ীরা এগিয়ে। জাতীয় সংসদেও তাদের বিস্তার বেড়েছে। ব্যবসায়ীরাই এখন দেশের আইনপ্রণেতা।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) তথ্যানুযায়ী, চলতি সংসদে সংসদ সদস্যদের মধ্যে অধিকাংশের পেশাই (৬৬.৮৯ শতাংশ বা ২০০ জন) ব্যবসা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে এ হার শতকরা ৬৫.৯২ শতাংশ (১৪৭ জন)। আবার নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে ২৯ জন (৯.৩৯ শতাংশ) আইনজীবী, (প্রকৃত তথ্য হবে ৩২ জন এবং ১০.৬৭ শতাংশ)। এই ৩২ জনের মধ্যে ২৬ জনই আওয়ামী লীগের। অর্থাৎ ব্যবসায়ী ও আইনজীবীরাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এগিয়ে রয়েছেন। মাঠের বা তৃণমূলের প্রকৃত রাজনীতিবিদরা দলে গৌণ হয়ে পড়েছেন। 

দলটির শীর্ষ পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। সম্প্রতি সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রাজনীতি করলে কি ব্যবসা করার অধিকার থাকবে না? চাঁদা তুলে ভাত খাবে? চাঁদা তুলে পরিবার চালাবে? ব্যবসা করলে তো আপত্তি নেই। সৎ ব্যবসা করলে আপত্তি নেই।

সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম ঢাকা পোস্টকে বলেন, একসময় রাজনীতি করতেন, মাঝে ব্যবসার দিকে চলে যান। এখন তারা রাজনীতির মূল স্রোতধারায় চলে আসছেন। জীবনে কোনোদিন রাজনীতি করেননি এরকম দু’একজনও থাকতে পারে। ৬৭ শতাংশ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী, এটা ঠিক নয়। যাকে আপনারা ব্যবসায়ী ধরছেন তিনি এখন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হতে পারেন। তার যদি রাজনীতির অতীত ধরা হয়, দেখা যাবে তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করেছেন, ছাত্ররাজনীতি থেকে পরে ব্যবসা করে সফল হয়েছেন। এখন তিনি মূল স্রোতধারায় এসে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। সাবেক ছাত্রনেতারা বৈধ আয় করে এখন রাজনীতিতে আছেন। রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদের প্রভাব কমে যাচ্ছে আর ব্যবসায়ীদের প্রভাব বাড়ছে, বিষয়টি এমন নয়। রাজনীতিবিদরা এখন ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

দলীয় সূত্র মতে, টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির ক্ষমতায়ন পারিবারিকভাবে গড়ে উঠেছে। প্রতিটি জেলা কিংবা উপজেলায় এক বা দুটি পরিবারের কাছে স্থানীয় রাজনীতি বন্দি রয়েছে। একই পরিবার ক্ষমতার চারদিক আঁকড়ে ধরে রেখেছে। কেউ এমপি, কেউ উপজেলা চেয়ারম্যান, কেউ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা জেলা পরিষদের সদস্য। তারা একই পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ভাগভাটোয়ারা করে ক্ষমতা ভোগ করছে। আবার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় গড়ে উঠেছে ভুঁইফোঁড় অনেক সংগঠন। তারাও দলের নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে।

বর্তমানে দেশে বেশ আলোচনা হচ্ছে আমলাদের দুর্নীতি নিয়ে। সেখানে স্থান পেয়েছে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য ড. মতিউর রহমান, পুলিশের আরেক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও ঢাকার সিটি এসবিতে (নগর স্পেশাল ব্রাঞ্চ) কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল।

দলীয় সূত্র মতে, এনবিআর সদস্য মতিউরের বাবা যেমন রাজাকার ছিলেন তেমনি তার প্রথম স্ত্রীর বাবাও ছিলেন রাজাকার। অথচ তার প্রথম স্ত্রী এখন আওয়ামী লীগের হয়ে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান। আবার যে তিন প্রভাবশালী তাকে প্রশ্রয়ে দিয়েছেন, তাদের এক জনের বাবাও রাজাকার। তারা একত্রিত হয়ে আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী বনে গেছেন।

ফলে আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের যে গৌরবময় অধ্যায় সেখানে কিছু কিছু জায়গায় ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’র মতো বিষয় রয়ে গেছে এবং দলটি তার সুসময়ের ফল প্রকৃত ত্যাগী নেতাকর্মীদের হাতে তুলে দিতে পারছে না- এ অভিযোগ অনেকাংশেই সত্য। জ্যেষ্ঠ অনেক নেতার পাশাপাশি তাই বর্তমান সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল নেতারাও এ বিষয়ে দলের হাইকমান্ডকে আরও যত্নশীল পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।

এমএসআই/এসএসএইচ