উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপ অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল ৮ মে (বুধবার)। এদিন সারা দেশে ১৩৯ উপজেলায় একযোগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এবারের নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না হলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাই এতে অংশ নিচ্ছেন। কেউ আনারস প্রতীক, কেউ মোটরসাইকেল আবার কেউ দোয়াতকলম কিংবা ঘোড়া প্রতীকে নির্বাচন করছেন।

স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আবার তৃণমূলেও বিভক্তি দেখা দিয়েছে। 

তবে তৃণমূল নিয়ে চিন্তিত নন দলটির সিনিয়র নেতারা। বিভিন্ন সময়ে তাদের বক্তব্যে তৃণমূল নিয়ে মাথা না ঘামানোর বিষয়টি উঠে এসেছে।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচন

নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক করতে উপজেলা পরিষদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেয় ক্ষমতাসীনরা। এরপর ভোটের মাঠে দেখা মেলে বর্তমান সংসদ সদস্যদের আত্মীয়-স্বজনদের। যা নিয়ে বিভক্তির সূত্রপাত। দলীয় প্রতীক না থাকায় ক্ষমতাসীন নেতাদের ছেলে-মেয়ে কিংবা স্ত্রী অথবা কোনো আত্মীয় নির্বাচনী মাঠে লড়ছেন। যার প্রভাবে অনেকটা কোণঠাসা তৃণমূলের অন্য নেতাকর্মীরা। আবার অনেক জায়গায় প্রভাবশালী উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এর ফলেও নির্বাচনী মাঠে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা একেকজন একেক পক্ষ নিয়ে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছেন। কেউ চেয়ারম্যানের পক্ষে, কেউ আবার এমপির আত্মীয়-স্বজন কিংবা এমপি-সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন।

এক কথায় স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের গ্রুপিং সক্রিয় হয়ে উঠেছে। হামলা-মামলা ও সংঘর্ষের মতো ঘটনাও ঘটছে। নির্বাচনের মাঠে বিরোধী দল না থাকায় একক নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে গ্রুপিং রাজনীতি সক্রিয় হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক প্রার্থী।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের কথা। সেখানে এবার চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন দুজন। তারা সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। চাচা-ভাতিজার লড়াইয়ে কে বিজয়ী হবেন সেটা নিয়ে এখন আগ্রহ সাধারণ ভোটারদের। দুই প্রার্থীর মধ্যে একজন হলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খানের জ্যেষ্ঠ পুত্র আসিবুর রহমান খান। এমপিপুত্র কেন্দ্রীয় যুবলীগের কার্যকরী সদস্য ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি। প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক প্রার্থী শাজাহান খানের চাচাতো ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পাভেলুর রহমান শফিক খান। শাজাহান খানের চাচাতো ভাই হলেও শফিক খান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিমের অনুসারী।

বামে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম, ডানে শাজাহান খান / সংগৃহীত

মাদারীপুরে জেলা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ কয়েকটি সংগঠনের নেতৃত্বে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের অনুসারীরা রয়েছেন। ফলে চেয়ারম্যান প্রার্থী পাভেলুর রহমান শফিক খান পেয়েছেন স্থানীয় সমর্থন। তবে থেমে নেই এমপিপুত্র আসিবুর রহমান খানও। কাউকে কোনো অংশে কম মনে করছেন না সেখানকার ভোটাররা।

উপজেলা নির্বাচন ঘিরে সংঘর্ষ

গত ২ মে সন্ধ্যার দিকে পাবনার সুজানগরে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় দুজন গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশসহ আহত হন সাতজন।

একই দিন বরিশালের গৌরনদীতে উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে এক পক্ষের একজন গুলিবিদ্ধ হন। অপর পক্ষের কর্মী ইউপি চেয়ারম্যানসহ দুজনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করা হয়।

বেলকুচি থানা / সংগৃহীত

এর আগের দিন ১ মে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানায় ঢুকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের এক চেয়ারম্যান প্রার্থীকে পেটান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তার সমর্থকেরা। হামলার শিকার প্রার্থীর নাম বদিউজ্জামান ফকির। তিনি মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনি জেলার এনায়েতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক। সেখানে হামলাকারী দলের নেতৃত্ব দেন দোয়াত-কলম প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী আমিনুল ইসলাম। তিনি বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। তিনি সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি-চৌহালী) আসনের সংসদ সদস্য আবদুল মোমিন মণ্ডলের সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী বলে নিজেকে প্রচার করছেন।

‘নির্বাচন উন্মুক্ত থাকায় দূরত্ব বাড়ছে, তবে সংঘাতের ঘটনা সামান্য’

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত থাকায় আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং স্থানীয় ইকুয়েশনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা নিজেদের মতো বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে, বিপক্ষে কাজ করছেন। ফলে দূরত্ব কিছুটা বাড়ছে। তবে সংঘাতের ঘটনা খুব সামান্য।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন / ফাইল ছবি

গ্রুপিং ও সংঘর্ষের মতো ঘটনায় কেন্দ্র কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না বা কোন কৌশলে তৃণমূলকে ঐক্যবদ্ধ রাখবে— এমন প্রশ্নের জবাবে আবু সাঈদ বলেন, বর্তমান নির্বাচনটি অবাধ, নিরপেক্ষ, উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা আমাদের লক্ষ্য। নির্বাচনের পর সবকিছু প্রশমিত হবে। আওয়ামী লীগ একটি আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচনের পর আদর্শিক ভিত্তির ওপর আবার দলকে ঐক্যবদ্ধ করা হবে। আদর্শিক কারণে নির্বাচনকেন্দ্রিক দূরত্ব কমে আসবে। এই বিষয়ে বেশি উৎকণ্ঠিত হওয়ার মতো নেতিবাচক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি।

‘সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছি নির্বাচন যেন সংঘাতমুক্ত হয়’

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্বাচন যেন সংঘাতমুক্ত হয় সেজন্য আমরা সবাইকে নিদের্শনা দিয়েছি। মানুষ যেন নিরাপদে ভোট দিতে পারে সেই ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন / ফাইল ছবি

নির্বাচনে যে সংঘাত হয় তা কেন্দ্র থেকে নির্মূল করা সম্ভব কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা কেউ পারবে না। স্থানীয় নির্বাচনে ছোটখাট সংঘাত হবেই। এটা পারিবারিক ব্যাপার, গ্রামের ব্যাপার, ইউনিয়ন-ইউনিয়ন প্রতিযোগিতার ব্যাপার। একটা ইউনিয়নে একজন চেয়ারম্যান প্রার্থী, আরেকটা ইউনিয়নে আরেকজন প্রার্থী। তখন আওয়ামী লীগ-বিএনপি থাকে না, সবাই এক হয়ে যায়। তখন কিছু কিছু জায়গায় সংঘাত হয়।

স্থানীয় নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা নতুন কিছু নয় : কাদের

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা নতুন কিছু নয় বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের / ফাইল ছবি

উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে হামলা কিংবা সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটছে, সেগুলোকে আপনারা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন— ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনাগুলো নতুন কিছু নয়। আমরা চেষ্টা করছি এগুলো যেন না হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে সব দেশের নির্বাচনের নমুনা আমরা দেখেছি। আমাদের দল থেকে সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছি যেন সহিংসতা, মারামারির মতো বিষয়গুলো পরিহার করা যায়।

এমএসআই/এমজে