ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইসলামী আন্দোলনের উদ্যোগে  আয়োজিত জাতীয় সংলাপে অংশ নিয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন বিভিন্ন দলের নেতারা।

মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত রাজধানীর রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নসরুল হামিদ মিলনায়তনে রাজনৈতিক দল, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে এ জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।

এতে লিখিত বক্তব্য পেশকালে দেশের সংকটময় পরিস্থিতির জন্য সুনির্দিষ্ট ১১টি কারণ ও তিন দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর চরমোনাই পীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম।

সংলাপে বিএনপির শীর্ষ নেতা নজরুল ইসলাম খান বলেন, আন্দোলনরত সব বিরোধী দল এখানে উপস্থিত। এটা একটা বিশাল শক্তি। সরকারের জুলুম নির্যাতন আমাদেরকে এক হতে সহায়তা করেছে।

চরমোনাই পীরের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনি আজকে আশার আলো সঞ্চার করেছেন। এর সফলতায় আপনাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। যে দেশে গণতন্ত্র উপেক্ষিত, জনমতের প্রতিফলন নেই, মানুষ না খেয়ে মারা যায়, মানুষ বিচারহীনতায় ভোগে, নিরাপত্তা নেই, সুবিচার বঞ্চিত সেখানে এত উন্নয়ন মানে হলো কবরস্থানে আলোকসজ্জার নামান্তর ও অর্থহীন।

সংলাপে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ইসলামী আন্দোলনের স্মরণকালের সর্ববৃহৎ মহাসমাবেশ, তফসিলের প্রতিবাদে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও এবং একতরফা নির্বাচন বাতিলের দাবিতে অব্যাহত আন্দোলন করায় আমাদের আবেগ ও শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেছে।

তিনি বলেন, আমাদের সংশয় ছিল ইসলামী আন্দোলন নির্বাচনে যায় কি না। কিন্তু সংশয়কে পীর সাহেব ভুল প্রমাণিত করে দিলেন। আপনাদের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যমত্য তৈরি হয়ে গেছে। এখন সম্মিলিতভাবে ডাক দিলে সরকারের অস্তিত্ব থাকবে না। সরকারের পতন সময়ের ব্যবধান মাত্র।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড সাইফুল হক বলেন, আজকের সংলাপের বক্তব্যে নীতিগতভাবে সবাই একমত। ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপারে আমাদের সংশয় দূর হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, কাক নাকি কাকের গোশত খায় না। অথচ আওয়ামী লীগ নিজ দলের প্রার্থীদের ডামি প্রার্থী দিয়ে কাকের গোশত খাওয়া শুরু করেছে। বিরোধী দলগুলোকে বাইরে রেখে নির্বাচন চরম বেইমানি। নির্বাচনের আগেই কে বিরোধী দল হবে প্রধানমন্ত্রী তা ঠিক করছেন; জাতিকে তা দেখতে হচ্ছে, এটা নির্বাচনের নামে তামাশা। ভোট চোর-ভোট ডাকাতদের পক্ষে থাকায় ভারতের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতের পরাজয় প্রমাণিত।

গণঅধিকার পরিষদের একাংশের যুগ্ম-আহ্বায়ক কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান বলেন, শেখ হাসিনার প্রেতাত্মারা বিভিন্ন স্থানে বসে আছে। ১৫ বছরে তার সাজানো প্রশাসনের অধীনে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। 

তিনি বলেন, আজকে যে সংলাপ শুরু হলো, এটা যেন থেমে না যায়। মস্কো, ওয়াশিংটন বা দিল্লির আলাপ কাউকে হয়ত খুশি করতে পারে। কিন্তু গর্বিত বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে এটা মোটেও খুশির খবর নয়। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ এর জন্য দায়ী। বিদেশিদের বেশি অগ্রাধিকার দিলে দেশের সার্বভৌমত্ব ভূলুণ্ঠিত হবে। 

সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা কামাল মজুমদার বলেন, আমাদের রাজনীতি দিল্লী বা মস্কোর নয়, ঢাকার। মোবাইল ও বিকাশ ঘরে ঘরে চলে গেছে। চুরির বন্দোবস্ত বন্ধ করতে হলে ঘরে ঘরে ভোটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিরোধী দলের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়েছিল ২০১৮ সালে। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন কিন্তু হয়নি। এবারও যদি সরকারের সঙ্গে সংলাপ হয়ও তবে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে সেই গ্যারান্টি নেই। 

ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চেয়ারম্যান কে এম আবু তাহের বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে দেখছি ওনারা ইসলামী মূল্যবোধের ওপর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একঘরে করার চেষ্টা করেছে। একটা দেশের আশীর্বাদে গতবার নির্বাচনে এলেও এবার এক দফার আন্দোলন চলছে। গরুর হাটবাজার চলছে। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে পারে না। আসলে আওয়ামী লীগের বাইরে যারা থাকবেন তাদের কোনো অধিকার থাকবে না।

ইসলামী যুব মজলিস কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ফয়সল বলেন, বারবার সংবিধানের দোহাই দেয় সরকার। অথচ সাংবিধানিক কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করছে না। বাংলাদেশের মানুষ একমত ঐক্যবদ্ধ, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি এম আবদুল্লাহ বলেন, জনগণের যে কথা সেই কথাগুলোই উঠে এসেছে সংলাপে। ইসলামী আন্দোলন যথার্থ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো গণমাধ্যম বা সংবাদ মাধ্যম নেই, সবই প্রায় প্রচার মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ততটুকুই আসছে, যতোটুকু বিশেষ জায়গা থেকে অ্যালাউ করা হচ্ছে। সাংবাদিক বন্ধুরা রাস্তায় পিটুনি খাচ্ছেন। 

ভাসানী অনুসারী পরিষদের সদস্য সচিব হাবিবুর রহমান রিজু বলেন, চোরে শোনে না ধর্মের কাহিনি। পুরো দেশ আজ কারাগারে পরিণত। দেশের টেকসই রাজনীতি ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। যে কারণে সরকার পতনের আন্দোলন করতে হয়। নাগরিক সনদ প্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যেই সনদের অধীনে দেশে রাজনীতি চলবে। 

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক অ্যাড. হাসনাত আব্দুল কাইয়ুম বলেন, আজকে যে জুলুম চলছে তা নানা আইনের নামে। আজ প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়ানো যাচ্ছে না শিশু সন্তানদের কান্না আর আহাজারিতে। বিচারের নামে যা হচ্ছে তা কোনো বিচার নয়। যারা ক্ষমতায় আছে, তারা আসলে সরকার না, অবৈধ ও মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করেছে। সামনে যে নির্বাচনের তোড়জোড় তা নির্বাচন না, এটা সিলেকশন। রাষ্ট্র ও ক্ষমতা কাঠামো সংস্কার করতে হবে। রাজনীতির মূলকেন্দ্র থেকে মাফিয়াদের হঠাতে হবে। 

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, এলডিপির একাংশের মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, গণসংহতি আন্দোলনের বাচ্চু ভূঁইয়া, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই, মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন।

আরও উপস্থিত ছিলেন সম্মিলিত ওলামা মাশায়েখ পরিষদ সভাপতি খলিলুর রহমান মাদানী, গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাবেক এমপি গোলাম মাওলা রনি, এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মন্জু, গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুর, বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আব্দুল লতিফ মাসুম ও জাগপার সহ-সভাপতি রাশেদ প্রধানসহ বিভিন্ন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। 

জেইউ/কেএ