বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্যে শর্তহীন সংলাপ চাইছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো শেষ পর্যন্ত সংলাপে বসবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে তফসিল ঘোষণার আগে যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হচ্ছে না, সেটি অনেকটাই নিশ্চিত।

এদিকে, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচনের লক্ষ্যে সামনে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো। আর শিগগিরই তফসিল ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যেকোনো দিন ভোটের তারিখ জানিয়ে মনোনয়নপত্র জমার শেষ তারিখ ঘোষণা করতে পারে সংস্থাটি।

তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংলাপে বসার ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি। তবে সংলাপে বসতে প্রস্তুত রয়েছে জাতীয় পার্টি।

সংলাপে বসার ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি। তবে, সংলাপে বসতে প্রস্তুত রয়েছে জাতীয় পার্টি।

ঢাকার এক কূটনীতিক জানান, প্রায় বছরখানেক ধরে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বার্তা দিচ্ছে তারা। দেশটির উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, নির্বাচন ইস্যুতে মনে হয় তাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখবে তারা। তবে যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই তো আর সংলাপ হবে না। সংলাপ হবে কি হবে না তা পুরোপুরি নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর।

তফসিল ঘোষণার আগে তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। সোমবার (১৩ নভেম্বর) সেই চিঠি বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কাছে পৌঁছে দেয় ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। ডোনাল্ড লু’র লেখা চিঠি হাতে পাওয়ার বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগকেও চিঠি দেওয়া হবে বলেও জানা গেছে।

বিএনপি সংলাপে বসবে কি না, জানতে চাইলে নাম না প্রকাশের শর্তে দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, সংলাপ কে করবে বা কাকে নিয়ে আমরা সংলাপ করব? দলের মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতারা কারাগারে রয়েছেন। অন্যদের পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। দলের প্রায় ১৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তাহলে সংলাপটা কে করবে, কীভাবে করবে? দলটির স্থায়ী কমিটি নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে সংলাপে বসা না বসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলেও জানান এই বিএনপি নেতা।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংলাপের বিষয়ে তো আমি একা সিদ্ধান্ত নেব না। এটা দলগত সিদ্ধান্তের বিষয়। সংলাপের বিষয়ে এ মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের ব্যাপারে যখন তাগাদা দেওয়া হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে বেসামাল অবস্থা বিএনপির। ঢাকায় গত ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর মহাসচিবসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের অনেকেই কারাগারে রয়েছেন। গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে রয়েছে বাকি অনেক নেতা। এছাড়া, দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও তালাবদ্ধ। তাছাড়া, নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে দফায় দফায় অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে বিরোধী দলটি।

শর্তহীন সংলাপে বসা নিয়ে ডোনাল্ড লু’র লেখা চিঠি এখনো হাতে পায়নি আওয়ামী লীগ। চিঠি না পেলে দলটি সংলাপে বসবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানান দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমেরিকা জাতিগতভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি লালনপালন করে। সংবিধানের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল। এখন তারা যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সংলাপের কথা বলছে, আমাদের দেশে বিদ্যমান সংবিধানে সেটির কথা বলা আছে। ফলে, নতুন করে সংলাপের কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি না তা আমার বোধগম্য নয়।

সংলাপ নিয়ে অতীত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন আব্দুর রহমান। তিনি বলেন, সংলাপ তো অতীতে হয়েছে। সেসব সংলাপের অভিজ্ঞতা তো ভালো নয়। বরং তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারপরও আমাদের দল বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবে— সংলাপ করবে কি করবে না।

সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ না করার কথা বলে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে, সোমবার (১৩ নভেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের শর্তহীন বার্তার পর মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের ব্যাপারে সরকারের আপত্তি নেই। তবে কার সঙ্গে সংলাপ হবে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে মন্তব্য করেন ড. মোমেন। অবশ্য বন্ধু দেশ কোনো পরামর্শ দিলে সরকার তা মূল্যায়ন করে বলেও জানান মন্ত্রী।

কয়েকদিন ধরে সংলাপে বসতে রাজি থাকার বার্তা দিয়ে আসছে জাতীয় পার্টি। সংলাপ প্রসঙ্গে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের চেয়ারম্যান একাধিকবার সংলাপের ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। সেটি আমাদের দলের দাবি। সরকার সংলাপের উদ্যোগ নিলে আমরা অবশ্যই অংশ নেব।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেন, সরকারের কাছে আমরা দাবি জানাবো যে, আপনারা সংলাপের উদ্যোগ নেন। কারণ সংলাপ ছাড়া দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমাধান সম্ভব নয়।

নির্বাচনের তফসিল নিয়ে বুধবার (১৫ নভেম্বর) বৈঠক ডেকেছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল নিয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে এখনো কোনো বক্তব্য দেওয়া না হলেও ইসির সূত্র বলছে, আজ (বুধবার) বিকেলে কমিশনের বৈঠকের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে তফসিল ঘোষণা করতে পারেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। আর নির্বাচন হতে পারে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শর্তহীন সংলাপের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক দলগুলোকে যে বার্তা দিয়েছে, তা ইতিবাচক। তফসিল ঘোষণার আগে সংলাপ অনিশ্চিত। তবে, তফসিল ঘোষণার পরও সংলাপ হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলমান কিছু সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রথম পথ হচ্ছে সংলাপ। আর দ্বিতীয় উপায় হলো নিঃশর্ত সংলাপ। শর্তহীন সংলাপের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে আহ্বান করেছে, এটাকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখছি... সুনির্দিষ্ট কারণেই দেখছি। কারণ, সংলাপের আহ্বানের চাইতেও শর্তহীন সংলাপের বিষয়টি বেশি গুরত্বপূর্ণ। 

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত আছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই এবং এটা ভালোভাবে আছে ও দীর্ঘমেয়াদে চলছে। গণতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যার সমাধান চাইলে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। কারণ, সংলাপের বিপরীতে অবস্থান করে সংঘাত। নিশ্চয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি এটা চায় না।

অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, এটা না হলে সংলাপে বসব না, ওটা না হলে বসব না... এ রকম হলে তো সংলাপ হবে না। সংলাপে বসতে হবে নিঃশর্তভাবে। তফসিল ঘোষণার আগে সংলাপ হবে বলে মনে হয় না। কারণ পরিস্থিতি খুব জটিল। এখানে কোনো চটজলদি কোনো সমাধান হবে না। তফসিল ঘোষণার আগে সংলাপে বসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে তফসিল ঘোষণার আগে হলে ভালো। সংলাপ না হলে একেবারে সব ভেঙে পড়ল ব্যাপারটা এরকম না। আমি মনে করি, এখনো এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হওয়া সম্ভব।

গত ৩১ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠকের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাংবাদিকদের কাছে আশাবাদ প্রকাশ করেছিলেন যে, শর্তহীন সংলাপে বসবে রাজনৈতিক দলগুলো। এরপর সোমবার (১৩ নভেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলকে সংলাপে বসার আহ্বান জানানো হলো।

সোমবার (১৩ নভেম্বর) রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র স্টিফেন ইবেলি। সেখানে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। পাশাপাশি সহিংসতা পরিহার করে সব পক্ষকে সংযমী হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই সংলাপ চায় যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে, সেটিও তুলে ধরা হয়েছে।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র শর্তহীন সংলাপের কথা বলেছে। তিনটি প্রধান দলকে এ বার্তা দিয়েছে তারা (যুক্তরাষ্ট্র)। এখন রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসার বিষয়ে আন্তরিক হতে হবে। এক্ষেত্রে ক্ষমতায় যারা আছেন, তাদের দায়িত্বটা বেশি। তবে সংলাপে বসার পর তফসিল ঘোষণা করার দরকার ছিল। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর যে আর সংলাপ করা যাবে না, তেমনটা কিন্তু নয়।

এনআই/এএইচআর/কেএ