বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক উল্লেখ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ করেছে সরকার। আলাপ-আলোচনা, বোঝাপড়া ও সমঝোতার পথ আর খোলা নেই। তাদের একগুঁয়েমি মেনে নিয়ে কখনো আলোচনাও সম্ভব নয়। ইতিহাস সাক্ষি! আলোচনার পথ রুদ্ধ হলেই ‘পঁচিশের কালো রাত’ তৈরি হয়।

রোববার (১২ নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১২টায় পুরানা পল্টনের (নোয়াখালী টাওয়ার, ৩য় তলা) কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, রাজনীতিকে বলা হয় ‘আর্ট অফ কম্প্রোমাইজ’। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে সেই কম্প্রোমাইজেশন ও বোঝাপড়া, সমঝোতার জায়গা রুদ্ধ হয়ে গেছে। এর দায় বর্তমান সরকারের। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, জানোয়ারদের সাথে কোন আলাপ-আলোচনা নাই, যখন দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অধিকাংশকে গ্রেপ্তার করা হয়, যখন প্রতিবাদ-সমাবেশে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয় তখন রাজনীতির প্রধান উপাদান আলাপ-আলোচনা, বোঝাপড়া ও সমঝোতার পথ আর খোলা থাকে না।

তিনি বলেন, তাদের ক্ষমতার স্বার্থে বিরোধী দলসমূহকে তাদের সব একগুঁয়েমী মেনে নিতে হবে। কোন বিষয়ে আলোচনা করা যাবে না। ইতিহাস সাক্ষি! আলোচনার পথ রুদ্ধ হলেই ‘পঁচিশের কালো রাত’ তৈরি হয়।

আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল থেকে কার্যত উগ্রবাদী দলে পরিণত হয়েছে দাবি করে পীর চরমোনাই বলেন, বিরোধীদলের রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আওয়ামী লীগও কর্মসূচি দিচ্ছে এবং সেইসব কর্মসূচির নামের সঙ্গে “শান্তি” থাকলেও কার্যত তা সন্ত্রাসের কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। লাঠি নিয়ে মহড়া, যাকে তাকে তল্লাশি করা, আতংক তৈরি করার যে কাজ আওয়ামী লীগ করছে তা ৭১ এর শান্তিবাহিনীর কথাই মনে করিয়ে দেয়।

কলঙ্কের নিম্নস্তরে পৌঁছেছে নির্বাচন কমিশন
বাংলাদেশ অতীতেও বিভিন্ন সময়ে লজ্জা ও বিবেক বর্জিত নির্বাচন কমিশন দেখেছে। কিন্তু বর্তমান কমিশন লজ্জা, বিবেক ও মেরুদণ্ডহীনতায় অতীতের সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। দেশের এরকম পরিস্থিতিতেও তারা তফসিল নিয়ে এগুচ্ছে। তারা ক্ষমতাসীনদের মনোরঞ্জনে কাজ করছে।

স্বকীয়তা ও আদর্শ হারানো জনপ্রশাসন
জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো দলের হয় না, এমনকি কোনো সরকারেরও হয় না। তারা হয় রাষ্ট্রের। তারা সরকারের অধীনে কাজ কবে বটে তবে নিজেদের সততা, নীতি ও আদর্শ দিয়ে সর্বদা জনতার স্বার্থেই তারা কাজ করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা এক হতাশাজনক চিত্র দেখতে পাচ্ছি। তারা সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের অন্যায় নির্দেশ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।

দেশের অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্য ও সুশাসনের চূড়ান্ত অবনতি
রিজার্ভ পরিস্থিতি, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের দুর্নীতি, লুটপাট, দ্রব্যমূল্য, টাকা পাচার, অদক্ষতা ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর আলাপ আলোচনা হয়েছে। আমরাও বারংবার এসব নিয়ে আন্দোলন করেছি। এখন নতুন করে এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না। এক কথায় বলতে গেলে সুশাসনের অভাবে দেশের অর্থনীতি আজ চরম বিপর্যস্ত।

তিনি বলেন, আমরা দেশের আইন-শৃঙ্খলা মেনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে এসেছি। নানাভাবে আমরা সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছি, চাপপ্রয়োগ করার চেষ্টা করেছি। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৩ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণবিস্ফোরণ দেখেছেন। সেখানে আমরা সরকারকে সতর্ক করে ১০ নভেম্বরের মধ্যে পদত্যাগ করার আহ্বান করেছিলাম। শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা ত্যাগের কথা বলেছিলাম।

তিনি ইসলামের রীতি উল্লেখ করে বলেন, ইসলামের রীতি হলো, কোনো শক্ত অবস্থান নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে সতর্ক করতে হয়, সময় দিতে হয়। আমরাও তা দিয়েছিলাম। আমরা নতুন কর্মসূচি দিচ্ছি।

আ.লীগের চরিত্র বদলায়নি প্রমাণ লক্ষ্মীপুর-বিবাড়িয়ার উপ-নির্বাচন
আওয়ামী লীগের চরিত্র পরির্বতন হবে না উল্লেখ করে পীর চরমোনাই বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো জাতীয় নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না। কারণ নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে যে আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা থাকার দরকার তা এই সরকারের নাই। এটা বারংবার প্রমাণিত হয়েছে। আমরা বিগত সময়ে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়ে তাদের শঠতা, প্রতারণা ও সহিংসতা মানুষের সামনে প্রকাশ করে দিয়েছি। আওয়ামী লীগের চরিত্র যে পরির্বতন হবে না সর্বশেষ লক্ষ্মীপুর ও বি-বাড়িয়ায় হয়ে যাওয়া দু’টি উপ-নির্বাচনও এর প্রমাণ।

সরকার জনমত উপেক্ষা করে বারংবার সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে। কিন্তু আমরা জানি, সংবিধানের গ্রহণ ও মান্যতা তৈরিই হয় “জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি” এর কারণে। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশে যা বলা হয়েছে তাতে এই সংবিধানের যে অংশে যাই থাকুক না কেন, কোনো অবস্থাতেই জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করার এখতিয়ার এই সংবিধান কাউকে দেয় না। তারপরেও সংবিধানের দোহাই দেওয়া নির্লজ্জ মতলববাজি ছাড়া আর কিছু না।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচনকালীন “জাতীয় সরকার” এর ধারণা পেশ করেছে। জাতীয় সরকারের ধারণা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদ্যমান সংবিধানের মান্যতাও রক্ষা করা যাবে একই সঙ্গে চলতি সংকট থেকেও উত্তরণ হওয়া যাবে। আর জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতিফলন ঘটাতে যদি সংবিধানের কোনো সংশোধনীও প্রয়োজন হয়, সে সুযোগও রয়েছে। অতীতে কারণে অকারণে ১৭ বার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি এবং নির্বাচন কমিশন কোনো দলীয় বা সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। এগুলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। অথচ এই দুই প্রতিষ্ঠানকে সংবিধান যে ক্ষমতা দিয়েছে তারও যদি অনুসরণ করা হয় তাহলেও জাতি সংকট থেকে মুক্তি পেতে পারে। অথচ আমরা কি দেখলাম? সিইসি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে এসে আওয়ামী লীগের নেতাদের মতো করেই কথা বলছেন।

শুরুতেই দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং মানুষের অধিকার রক্ষায় সংগ্রামরত সবার প্রতি সম্মান জানান। সংবাদ সম্মেলন থেকে তিনি নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিলসহ চার দফা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমানের সঞ্চালনায় এসময় উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই, দলের মহাসচিব প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন প্রমুখ।

জেইউ/এসএম