প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালকে ‘আওয়ামী টুর্নামেন্টের দলদাস রেফারি’ ও পুরো নির্বাচন কমিশনকে ‘ফেলুয়া’ বলছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটি গত ৩ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করে ১০ নভেম্বরের মধ্যে জাতীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার আল্টিমেটাম দিয়েছিল। তবে এর কোনোটিই ঘটেনি। নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করেনি। গঠিত হয়নি জাতীয় সরকারও। এরমধ্যে তফসিল ঘোষণার তোড়জোড় শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন।

আল্টিমেটাম শেষ, এবার কি করবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ? জানতে চাইলে দলটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন ঘেরাও, একই দাবিতে আন্দোলনে সক্রিয় অন্যান্য দলগুলোর শান্তিপূর্ণ যুগপৎ আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে নিজেরাও রাজপথে নামার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে দলটি।

রোববার (১২ নভেম্বর) দলটি নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক বসতে যাচ্ছে। সেখানে নতুন কর্মসূচির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। এরপরই তা দুপুরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানাবে দলটির আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম।

এরআগে গত ৩ নভেম্বর ভোটাধিকার ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াইয়ে নামতে প্রস্তুত আছি উল্লেখ করে আল্টিমেটার দিয়েছিলেন আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম।

তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশ থেকে ১০ নভেম্বরে মধ্যে সরকারকে পদত্যাগের আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে এক সপ্তাহের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে কারারুদ্ধ বিএনপিসহ সব শীর্ষ নেতাকে মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, সরকার এসব দাবি মেনে না নিলে, আন্দোলনরত সব বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সময়ে কঠোর ও বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণার কথা বলেন। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সব শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির এক যুগ্ম মহাসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিএনপি ও জামায়াতসহ অন্যান্য দলের শান্তিপূর্ণ চলমান কর্মসূচিতে আমির পীর চরমোনাই সমর্থন ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন। দলের পক্ষ থেকে আমির যে আল্টিমেটাম নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছিলেন তা তারা মানেনি। পদত্যাগ বা জাতীয় সরকার ঘোষণা কোনোটিই তারা করেননি।

উল্টো তফসিল ঘোষণার তোড়জোড় বন্ধের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, জনগণকে বেকায়দায় ফেলে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের জেলে ভরে সরকার যদি মনে করে এবারও পার পেয়ে যাবেন, সেটা এবার সম্ভব না। সেটা এবার করতে দেওয়া হবে না। নতুন কঠোর কর্মসূচিতে আমরা যাচ্ছি।

আল্টিমেটাম শেষ, তবে নতুন কি কর্মসূচি আসছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার একটা আলোচনা দলের মধ্যে হয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগও হচ্ছে। এই সপ্তাহেই নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করার কর্মসূচির ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনের ন্যায় আমরাও কর্মসূচি দেবো। তবে সেটা অন্য সমমনা সব দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাকি আলাদা হয়ে সেটার সিদ্ধান্ত হয়নি। কোনো কর্মসূচিই চূড়ান্ত নয়। তবে এসব ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। সহসা এব্যাপারে চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচির ঘোষণা আসছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুগপৎ আন্দোলনে এখনো আমরা যুক্ত হয়নি। তবে একই দাবিতে সমমনা ও আন্দোলনরত দলগুলোর শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচিতে সমর্থন জানিয়েছি। রোববার আমাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠক রয়েছে। সেখানেই চূড়ান্ত হবে পরবর্তী কর্মসূচি। এতোটুকু বলতে পারি, কঠোর কর্মসূচিই আসছে। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত কালিই জানিয়ে দেওয়া হবে।

দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশের পর দলীয় নেতাকর্মীরা অনেক চাঙ্গা রয়েছে। আমির পীর চরমোনাই যে আল্টিমেটাম দিয়েছেন সেটি নির্বাচন কমিশন মানেনি। আমরা আর আল্টিমেটাম দেবো না। সরাসরি কঠোর কর্মসূচিতে যাবো। অনেক সময় দিয়েছি, আর নয়।

তিনি বলেন, আগামী দিনে সরকার পতনে, নিরপেক্ষ জাতীয় সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে পরবর্তী নানা কর্মসূচির ব্যাপারে পরামর্শ এসেছে। সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কালকেই নতুন কর্মসূচির সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।

তফসিল ঘোষণার জন্য বর্তমান সময় মোটেও অনুকূলে নয়, সংঘাতময় পরিস্থিতিতে তফসিল ঘোষণা থেকে বিরত থাকতে ইসিকে আহ্বান জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির আমির মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই।

তিনি  শনিবার (১১ নভেম্বর) দুপুর ২টায় পল্টনের দলীয় কার্যালয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের ও দলের শীর্ষ দায়িত্বশীলদের সঙ্গে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাকালে এসব কথা বলেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন দলের মহাসচিব প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন।

তিনি বলেন, দেশের প্রবল সংঘাতময় ও অস্থিতিশীল সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে মরিয়া হয়ে উঠছে নির্বাচন কমিশন। পরিবেশ সৃষ্টি না করে সরকারের মনোবাসনা পূরণে তফসিল ঘোষণা করলে দেশ ভয়াবহ সংঘাতে পতিত হবে।

তিনি বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার জন্য বর্তমান সময় মোটেও অনুকূলে নয়। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে আগ্রহী নয়। জোর জবরধস্তির করে একতরফা নির্বাচন করলে নির্বাচন কমিশনকে রুখে দেবে জনগণ।

তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল আন্দোলন করে আসছে। নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি না করে এবং নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কী হবে তা ঠিক না করে কোনোভাবেই তফসিল ঘোষণা হতে পারে না। অতি সম্প্রতি দুটি উপ-নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। প্রকাশ্যে সিল মারার ভিডিও ফুটেজ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। কেন্দ্র দখল, পেশিশক্তির প্রয়োগ করে ভীতিকর পরিবেশে নির্বাচন করে জাতীয় নির্বাচনের মমো একটি নির্বাচন করার সাহস করে কীভাবে? কাজেই তফষিল ঘোষণা না করে পদত্যাগ করা উচিত দলবাজ সিইসির।

তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন করতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচনের তফসিল সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে না। আন্দোলনকারী দল ও দেশবাসী এই তফসিল মানবে না। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এ রকম অবস্থায় একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা চরম কাণ্ডজ্ঞানহীন হিসেবে চিহ্নিত হবে।

যুগপৎ আন্দোলনে ইসলামী আন্দোলনকে চায় জামায়াত
জামায়াতে ইসলামের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো আল্টিমেটাম মানছে না সরকার। সরকারকে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই হঠাতে হবে। এজন্য চলমান আন্দোলনে যুক্ত করতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে যুগপৎ কিংবা সমন্বিত আন্দোলনে চায় জামায়াতে ইসলামী।

এব্যাপারে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুগপৎ আন্দোলন চলছে। চলমান আন্দোলনে ইতোমধ্যে বেশ কিছু দল নিজ নিজ দলীয় অবস্থান থেকে পালন করছেন। ইতোমধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চলমান আন্দোলনমুখী কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়েছেন। আমরা আশা করবো তারাও যুগপৎ কর্মসূচিতে যুক্ত হবেন।

তিনি বলেন, জামায়াত ইসলামী ও বিএনপির সঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। আপাতত আমাদের দলীয় কর্মসূচি দুদিনের অবরোধ কাল থেকে আবার শুরু হচ্ছে। এটি শেষ হওয়ার পর আমরা নতুন কর্মসূচি দেবো। সেটা যুগপৎ আন্দোলনে থেকে নাকি সমন্বিত কর্মসূচি হবে সেটি এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

জেইউ/এসএম