হেফাজত-সরকার সম্পর্ক, সমঝোতা নাকি দ্বন্দ্ব?
বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে সরকারের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তলানিতে চলে গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে হেফাজতের মোদিবিরোধী কর্মসূচিতে ব্যাপক সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এতে সারাদেশে ডাকা হরতাল পালনের সময় অন্তত ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় দেশব্যাপী ৪৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যাতে হেফাজতের শীর্ষ নেতাসহ ১০ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
এ অবস্থায় বিভিন্ন মহলে অলোচনা হচ্ছে হেফাজত-সরকার সম্পর্ক আগের মতো থাকবে নাকি এ সম্পর্ক ভেঙে যাবে?
বিজ্ঞাপন
হেফাজতে ইসলামের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে গণজমায়েতের পর সংঘর্ষের ঘটনায় ১২টি মামলা করা হয়। কিন্তু সরকারের সঙ্গে অলিখিত সমঝোতার ফলে এসব মামলাগুলো নিষ্ক্রিয় ছিল। এবারের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে হওয়া মামলাগুলো প্রত্যাহার ও মৃত নেতাকর্মীদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানোর পরিকল্পনা রয়েছে হেফাজতের। এটি মেনে নিলে হেফাজত ও সরকারের মধ্যে একটা সমঝোতা হতে পারে।
তবে, মোদিবিরোধী কর্মসূচির পর সম্প্রতি হেফাজত নেতা মামুনুল হক ইস্যুতে সংসদে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সরকারের কঠোর অবস্থানের বার্তা দেয়। তাই আপাতত আইনি প্রক্রিয়ায় এসব মামলা মোকাবিলা করা হবে বলে জানিয়েছেন হেফাজত নেতারা। সরকারের অবস্থা বুঝে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।
হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলা করেছে সরকার। এ বিষয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে কথা বলব। পাশাপাশি আইনিভাবেও মোকাবিলা করব।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সমঝোতা করার কিছু নেই। তারা (সরকার) যদি মনে করে সমঝোতায় আসা দরকার সেটা তারা করবে। আমাদের কথা হলো, এগুলো মিথ্যা মামলা, এসব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। তারা মামলা প্রত্যাহার না করলে আমরা আইনগতভাবে লড়ব। এখানে আপস করার কিছু নেই।
হেফাজত কোনো অন্যায় করেনি দাবি করে আব্দুর রব ইউসুফী বলেন, আমরা অন্যায়কে ন্যায় বলতে পারব না। জেল-ফাঁসি মাথায় নিয়েই আন্দোলন করি। যারা আন্দোলন করেন তারা এসব জেনেই করেন।
সংগঠনের আরেক নায়েবে আমির মাওলানা আহমেদ আব্দুল কাদের ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলাগুলো প্রত্যাহারসহ অন্যান্য দাবি জানাব। সরকার মেনে নিলে ভালো, নাহলে আইনিভাবে বা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করব। এখানে আর কিছু বলার নেই।
হেফাজতের পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে আব্দুল কাদের বলেন, এই মুহূর্তে কীভাবে বলব। আমরা আমাদের দাবিগুলো পেশ করব। পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, তার ওপর নির্ভর করবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতেই পারছেন, আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক। তারপর দেখা যাবে কী করা যায়। সরকারের সঙ্গে সমঝোতা কোনো বিষয় নয়। আমরা আমাদের ন্যায্য দাবি পেশ করব। মেনে নেওয়া, না নেওয়া তাদের বিষয়। আগেও তাদের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হয়নি। সামগ্রিক পরিস্থিতি ওই জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
হেফাজত নেতারা আরও বলছেন, হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। তবে সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। তাই বলে হেফাজতের আন্দোলনের লক্ষ্য সরকার পতন নয়। এসব আন্দোলনের লক্ষ্য সরকারকে চাপে রেখে কিছু দাবি-দাওয়া আদায় করা।
সরকারও সেটা বোঝে দাবি করে হেফাজত নেতারা বলেন, সাবেক আমির আহমদ শফীর মৃত্যুর পর যে কমিটি হয়েছে, সরকার তাদেরকে শত্রু মনে করছে। তাই ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের আন্দোলনের তুলনায় মোদিবিরোধী ‘নিরামিষ’ কর্মসূচিকে সরকার বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। ফলে, দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তারপরও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে টুকটাক কথা হচ্ছে। তবে, হেফাজত কোন পথে যাবে সেটা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হেফাজতের ঢাকা মহানগরের এক নেতা বলেন, আসলে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রক্রিয়ায় আমরা এগোতে পারিনি। মামলাগুলো কি আইনিভাবে মোকাবিলা করা হবে নাকি সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়া হবে সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এরপরও সরকারের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা হচ্ছে। কারণ সরকার পতনের কোনো লক্ষ্য আমাদের নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া হলে সব জায়গায় এর প্রভাব পড়বে।
অসন্তুষ্টি থাকলেও মামুনুলের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নয়
‘দ্বিতীয় স্ত্রী’ কাণ্ডে সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের প্রতি অসন্তুষ্টি থাকলেও এখনই তার বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে না হেফাজত। তার দল খেলাফত মজলিসও এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে না বলে জানা গেছে।
হেফাজত ও খেলাফত মজলিসের নেতারা বলছেন, মামুনুল হকের দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রকৃত বিষয়টি অনুসন্ধান করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে তিনি যেসব তথ্য-প্রমাণ হাজির করেছেন তাতে প্রমাণিত, এটি শরিয়াহ সম্মত বিয়ে। এতে তার কোনো নৈতিক স্খলন হয়নি। নৈতিক স্খলন না হওয়ায় আপাতত তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তবে, তার কিছু ভুল পদক্ষেপ রয়েছে বলে মনে করে হেফাজত ও খেলাফত মজলিস। যে কারণে তাকে উভয় পক্ষ থেকেই সর্তক করা হয়েছে।
হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী বলেন, মামুনুল হকের দ্বিতীয় বিয়ে বৈধ। তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে রিসোর্টে যেতেই পারেন। এ জন্য তার বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। কিন্তু সরকার তাকে হেনস্তা করে ভুল করেছে। আমরা এর বিচার চাই।
মামুনুল হক খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার দলের এক নেতা বলেন, এক কথায় বলতে গেলে মামুনুল হকের দ্বিতীয় বিয়ে অনেক পুরোনো একটা বিষয়। আমাদের কাছে যতটুকু মনে হয়, সরকার যেহেতু তার ফোন রেকর্ড করে, তারা আগে থেকেই জানত বিষয়টি।
তিনি বলেন, তারা এ সময়টার অপেক্ষায় ছিল। গোয়েন্দারা অনেকদিন ধরেই তার পেছনে লেগে ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী এ কাজ করা হয়েছে। তাকে আরও অনেক কিছুই করতে পারত। হয়ত অল্পতেই সেটা শেষ হয়েছে। তবে, মামুনুল হকের ভুল আছে। কেন তিনি এই সময়ে রিসোর্টে গেলেন? আবার কাউকে না জানিয়ে একা কেন গেলেন?
মামুনুল হকের প্রথম স্ত্রী ও ছেলেদের বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এই নেতা বলেন, কে বলেছে আপনাদের, তারা বাসা ছেড়ে চলে গেছে? এটি ভুল তথ্য। তারা মোহাম্মদপুরের মামুনুল হকের বাসাতেই আছেন। বুধবার আমরা একসঙ্গে বাসায় গিয়েছি। তবে, দ্বিতীয় স্ত্রী কোথায় আছে তা জানি না।
এএইচআর/ওএফ