জামায়াতের আল-কায়েদা ও আইএসসহ আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী শুধু বাংলাদেশের জন্য হুমকি নয়, সারা বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য জামায়াতের মৌলবাদী মতাদর্শ হুমকি। জামায়াতকে মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনা করা স্টেট ডিপার্টমেন্টের জন্য বড় ভুল ছিল।

শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় একুশে পদকজয়ী বাংলাদেশি-আমেরিকান কাউন্সিলম্যান ড. নুরুন নবীর উদ্যোগে ‘বাংলাদেশে সহিংসতা, গণতন্ত্র এবং মার্কিন নীতি’ শিরোনামে এক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা।

সেমিনারে অংশ নেন নর্থ ক্যারোলিনা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবিএম নাসির, মুক্তিযোদ্ধা ও মানবাধিকারকর্মী শাহরিয়ার কবির, মার্কিন মানবাধিকারকর্মী সেথ ওল্ডমিক্সন এবং মার্কিন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন।

বক্তারা বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন অন্য দেশের রাজনীতিতে কোনো নির্দিষ্ট দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতে পারে না, তেমনিভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা করার অধিকারও তাদের নেই। ডিমোক্রেসি সামিটে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না করে এবং পাকিস্তানকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আমেরিকা ইতোমধ্যে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অন্তর্ভুক্তি গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। রাজনীতি ও ধর্মকে আলাদা রাখা উচিত। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। আফগানিস্তানের পতনের পর বাংলাদেশও যদি ইসলামপন্থিদের হাতে যায়, তবে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।

ওয়েবিনারে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অতীতের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সহিংসতা, উদার-গণতন্ত্রের সম্ভাবনা ও সংকট, আমেরিকার নীতি বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে বিকশিত করবে কি না– এসব বিষয় আলোচনায় উঠে আসে।

সূচনা বক্তব্যে এবিএম নাসির বলেন, বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে দুই লাখ হিন্দু জনগোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন কিংবা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে জামায়াতের দেশব্যাপী সহিংসতায় ২০ পুলিশ সদস্য নিহত হন। 

তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণের তাগিদ দেন।

শাহরিয়ার কবির তার বক্তব্যে বিএনপি-জামাতের শাসনামলে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সংঘটিত সহিংসতার বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, সেসময়ে ৭০ ভাগ হিন্দু ভোটারের নির্বাচনে ভোট দেওয়া থেকে জোরপূর্বক বিরত রাখা হতো।

শাহরিয়ার কবির বলেন, ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশে মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সামরিক শাসকদের হাতে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা কাটা পড়ে। রাষ্ট্রে সব ধর্মাবলম্বীদের সমান অধিকার গণতন্ত্রের প্রধান পূর্বশর্ত। কিন্তু জামায়াত এ নীতিতে বিশ্বাস করে না। তাদের গঠনতন্ত্রে নারী ও বিধর্মীদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে। নারী নেতৃত্বকে জামায়াত অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করে। ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’ সংবিধান বর্ণিত এ নীতি জামায়াত কখনো গ্রহণ করেনি। জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় বাংলাদেশের আদালত দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা দেয়।

তিনি বলেন, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এখন বলছে জামায়াত একটি মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল এবং তাদের রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সমান সুযোগ থাকা উচিত। এটি স্পষ্টত একটি সার্বভৌম দেশের স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপ। আমেরিকাকে বুঝতে হবে বাংলাদেশ সরকার জামায়াতকে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত এবং শাসন বিভাগ থেকে এটি সম্পূর্ণ স্বাধীন। এখন মার্কিন চাপে জামায়াতকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না।

শাহরিয়ার কবির আশা প্রকাশ করেন, আগের মতো আবার মার্কিন জনগণ ও মিডিয়া মৌলবাদের বিপরীতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সমর্থন করবে। 

লিবার্টি সাউথ এশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সেথ ওল্ডমিক্সন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই সহিংসতা ও সন্ত্রাসকে সমর্থন করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের প্রতি। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জামায়াতকে সমর্থন করে না। কিন্তু তাদের বাংলাদেশ নীতি জামায়াতকে বিশেষ সুবিধা করে দিয়েছে এবং বাংলাদেশে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সহিংসতার দুয়ার খুলে দিয়েছে। 

ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন তার বক্তব্যে বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা, শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা ও দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলা, পাকিস্তান হাইকমিশনের উদ্যোগে অস্ত্র পাচারসহ নানাবিধ জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও মার্কিন সরকার তারেক রহমানের বিপক্ষে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবাদ প্রসারে তারেক রহমানের অবদান সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবর অবহিত ছিল। তবুও কূটনীতিকরা বিএনপিকে পুনর্গঠন ও তারেক রহমানকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কোনো চাপ প্রয়োগ করেননি। পৃথিবীর অন্য যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে তারেক রহমান যা করেছেন তা করার পর কেউ আর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারে না। বিএনপি-জামায়াত জোট আবার ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে কী ঘটতে পারে তা আমেরিকার বিবেচনায় রাখা উচিত।

/এসএসএইচ/