বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া/ ফাইল ছবি

প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা মাঠের বিরোধী দল বিএনপি ১ সেপ্টেম্বর ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে। ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে দলটি নানা সংকটে ধুঁকছে। কখনও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে না পারার ভুল, আবার কখনও নেতৃত্বের সংকট। যদিও দলটির নেতৃত্ব সংকট এখনও পুরোপুরি সমাধান হয়নি।

২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনেও দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনেকটা যৌথ সিদ্ধান্তে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে দলের একক নেতৃত্ব চলে যায় তারেক রহমানের হাতে। যার ফলে, বিএনপিতে ধীরে-ধীরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের আবেদন হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। নানা রোগে আক্রান্ত খালেদা জিয়াকেও এখন অধিকাংশ সময় হাসপাতালের বেড়ে শুয়ে কাটাতে হচ্ছে। সবশেষ গত ১৬ দিন ধরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

বিএনপির নেতারা বলছেন, গত ১৭ বছর ধরে বিএনপি ভাঙার নানান ষড়যন্ত্র হলেও তা বাস্তবায়নে সফল হয়নি সরকার। কিন্তু আগামী নির্বাচনের আগে দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করতে না পারলে এই সংকটে আবারও পড়বে দলটি। বিএনপি যদি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে তাহলে বিভিন্ন দিকের প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে দলের ছোট একটি অংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। যার ফলে, আগামী নির্বাচনে আগে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করার যেমন চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তেমনি রয়েছে দলের ঐক্য ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ। তাই আগামীতে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার চূড়ান্ত পরীক্ষায় নামতে হবে বিএনপিকে।

আরও পড়ুন : গুজব নিয়ে আতঙ্কে বিএনপি

বিএনপির নেতারা আরও বলছেন, ২০২০ সালে সরকারের শর্তে রাজি হয়ে ‘কারাগার থেকে বেরিয়ে’ খালেদা জিয়া তার নিজের ‘আপসহীন’ নেত্রীর উপাধিতে দাগ লাগিয়েছেন। বয়স আর নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে নিজের উত্তরসূরি ছেলের হাতে দলের নেতৃত্ব তুলে দিয়ে নেতাকর্মীদের কাছে হারিয়েছে নিজের আবেদন। যার কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন হিসেবে খালেদা জিয়া এখন আলংকারিক পদবি নিয়ে রয়েছেন। যে পদের কোনো কার্যক্রম নেই। অন্যদিকে তারেক রহমানের নেতৃত্বে ও তার কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি থাকলেও প্রকাশ্যে কিছু বলতে নারাজ।

‘সৃষ্টিকর্তার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র’- এই চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা করেন জিয়াউর রহমান। এরমধ্যে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব দলটির পূর্ণ মেয়াদে ২ বার রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিলেন। এছাড়া একবার অল্প কয়েকদিনের জন্য ক্ষমতায় ছিলেন।

আরও পড়ুন : ঢাকা-৭ আসন জোট সঙ্গীদের ছেড়ে দিতে পারে বিএনপি

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে বহু দলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে জিয়াউর রহমান। খালেদা জিয়া সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে গণতন্ত্রের স্বার্থে। এখন আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। জনগণকে তাদের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। সেজন্য আমরা আন্দোলনে আছি। পুরো জাতি এক হয়েছে এই সরকারের বিরুদ্ধে।

সরকারের পদত্যাগের দাবি আদায়ে বিএনপি ব্যর্থ হলে তখন দল ভেঙে একটি অংশ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া আশঙ্কা রয়েছে, -এমন এক প্রশ্নের জবাবে টুকু বলেন, ২০১৪ সাল থেকে বিএনপিকে ভাঙার বহু প্রচেষ্টা হয়েছে। এখন কোনো অগ্রহণযোগ্য লোককে নিয়ে কিছু যদি করে সেটা করতেই পারে। কিন্তু বিএনপির মূল নেতৃত্ব ও সমর্থকদের পথভ্রষ্ট করা যাবে না। দুই-একজন লোক লোভে যেতে পারে। কিন্তু বিএনপিকে পথভ্রষ্ট করা যাবে না।

বিএনপিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) শূন্যতা তো পূরণ করা যাবে না। তার শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব নয়। ম্যাডাম মানেই হচ্ছে বিএনপি। কিন্তু আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলকে সঠিকভাবে পরিচালনা করছেন বলেই দল জেগে উঠেছে। তিনি তার প্রচেষ্টা দিয়ে প্রমাণ করেছেন তারেক রহমান সফল সংগঠক।

বিএনপির নেতারা বলছেন, বিএনপির এখন সামনে মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও নেতৃত্বের সমন্বয়হীনতা উতরে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় চলমান আন্দোলনকে সফল করে তোলা। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পক্ষে বিএনপির যে শক্ত অবস্থান, সেটা শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখা। কারণ ইতোমধ্যে দলটির একাংশ নির্বাচন বয়কটের পক্ষে নয়। সংলাপের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে তারা ভোটে যাওয়ার পক্ষে। এসব নেতাদের দাবি- সরকার যদি অতীতের মতো আরেকটি নির্বাচন করে উতরে যায়, তাহলে রাজনৈতিকভাবে বিএনপির ভবিষ্যৎ কী হবে সেটা নিয়েও ভাবতে হবে।

আরও পড়ুন : বাস্তবতার নিরিখে নতুন কর্মসূচি চায় বিএনপির সঙ্গীরা

এছাড়াও বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য ধরে রাখাও অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, আগামীতে এসব দলের সামনে বিভিন্ন মহল থেকে চাপের পাশাপাশি নানা সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেওয়া হবে। চাপ সামলে এবং লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে গিয়ে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য ধরে রাখাও বড় চ্যালেঞ্জ।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই সরকার নির্বাচন পর্যন্ত থাকবে এবং তারা নির্বাচন করবে এটা আমি বিশ্বাস করি না। এই সরকারের কোনো ক্ষমতা নেই নির্বাচন করার। কারণ তাদের কেউ বিশ্বাস করে না। একমাত্র পুলিশ তাদের বিশ্বাস করে। আর পুলিশের কারণে জনগণ এই সরকারকে অবিশ্বাস করে, যে তারা ভোট দিতে পারবে না। আর তারা যেন-তেন নির্বাচন করে এবার আর পার পেয়ে যেতে পারবে না।  

যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার এক প্রশ্নের জবাবে গয়েশ্বর বলেন, আমি আশা করি তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন। জনগণের পাশে তারা থাকবেন। এটা শুধু বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ নয়, সারা জাতির জন্য চ্যালেঞ্জ।

আরও পড়ুন : কঠোর গোপনীয়তায় বিএনপি, সঙ্গীদেরও জানাচ্ছে না কর্মসূচি

বিএনপি ঘরানার রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, এক দফা দাবিতে বিএনপিকে রাজপথে সরব থাকতে হবে। শক্ত হাতে দলের বিরুদ্ধে যেকোনো অপপ্রচার মোকাবিলা করতে হবে। দল ভাঙার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে শীর্ষ নেতাদের। কারণ, এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন, ক্ষমতাসীন মহল চেষ্টা করবে প্রলোভন দেখিয়ে বিএনপি থেকে কাউকে নিয়ে দলে ভেড়ানোর। পাশাপাশি দলটি আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার যে অঙ্গীকার বিএনপি করেছে, এ সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হবে।

দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিএনপির কর্মসূচি

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে শুক্রবার সকাল ৬টায় দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করবে বিএনপি। দুপুর ১২টায় বিএনপির সিনিয়র নেতারা শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা ও বিশেষ দোয়া করবেন। বিকেল তিনটায় নয়াপল্টন থেকে শোভাযাত্রা বের করবে। পাশাপাশি ২ সেপ্টেম্বর (শনিবার) বিএনপির উদ্যোগে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও দলীয় পোস্টার ও ক্রোড়পত্র প্রকাশসহ সারাদেশে সব ইউনিট বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করবে।

এএইচআর/এসএম