বাসে বাসে আগুন, পুলিশসহ আহত শতাধিক
হঠাৎ কর্মসূচিতে রাজধানীতে রাজনৈতিক উত্তাপ
নির্বাচনকে সামনে রেখে হঠাৎ করেই দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রাজপথে শক্তি প্রদর্শনে ব্যস্ত। শুক্রবার বিএনপি-আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ থেকে এর সূত্রপাত। যার ধারাবাহিকতায় আজ শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি-পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
এ সময় পুলিশের গাড়ি ও একাধিক যাত্রীবাহী বাসেও আগুন দেওয়া হয়। যার ফলে বহুদিন পর রাজনৈতিক ‘উত্তাপ’ দেখা দিয়েছে রাজধানীতে।
বিজ্ঞাপন
শনিবার (২৯ জুলাই) রাজধানীতে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের এক যুগ্ম কমিশনারসহ ২০ সদস্য আহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন বিএনপির শতাধিক নেতা-কর্মী। আটক করা হয়েছে দলটির ৯০ নেতাকর্মীকে।
এদিন বিএনপির বড় দুই নেতাকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হলেও পরবর্তীতে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ধোলাইখালে সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রায় ২ ঘণ্টা পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আরেক নেতা দলটির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান কর্মসূচি পালনের সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে গাড়িতে করে নিয়ে যায় পুলিশ।
বিএনপি ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার সকালে হঠাৎ করেই জানানো হয় শুক্রবারে দেওয়া পূর্বঘোষিত কর্মসূচি চালিয়ে যাবে বিএনপি ও বিরোধী দলগুলো। এরপরই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। নেতা-কর্মীরা রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান নেন। পুলিশ তাদেরকে সরে যেতে বললে বাধে সংঘর্ষ। একপর্যায়ে মাতুয়াইলে একাধিক যাত্রীবাহী বাস এবং শ্যামলীতে পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে পুলিশের ২০ জন এবং বিএনপির ৯০ নেতাকর্মী আহত হন। এছাড়া বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছাড়া পান আর অসুস্থ আমানউল্লাহ আমানকে দেখতে যান প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিদল।
দিনভর দুই রাজনৈতিক দল ও পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা আলোচনায় থাকলেও হঠাৎ বিকেলে ডিবি কার্যালয়ে ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদের সঙ্গে গয়েশ্বর চন্দ্রের খাবারের ভিডিও ভাইরাল হয়। এরপরই পুলিশ-নেতার এই আহার নিয়ে নানামুখী আলোচনা ও সমালোচনায় মাতেন নেটিজেনরা।
সংঘর্ষের সূত্রপাত যেভাবে
বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় সকালে, ধোলাইখাল এলাকায়, বিএনপির অবস্থান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। বেলা ১১টায় স্লোগানে স্লোগানে ধোলাইখাল মোড়ে অবস্থান নেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে বেলা সাড়ে ১১টায় পুলিশের সঙ্গে নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। এ সময় পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের সরে যেতে বললেও তারা অনড় অবস্থানের কথা জানায়। একপর্যায়ে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ। জবাবে ইট-পাটকেল ছোড়েন অবস্থানকারীরা। এরপর ধোলাইখাল এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। ঘটনাস্থল থেকে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে হেফাজতে নেয় পুলিশ।
লালবাগ বিভাগের ডিসি জাফর হোসেন ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, এখানে সমাবেশ করার জন্য কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। এরপরও বিএনপি নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন গলিতে এসে জড়ো হয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চড়াও হয়। একপর্যায়ে আমরা আত্মরক্ষা শুরু করি। এ ঘটনায় আমাদের বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। একজনের মাথা ফেটে গেছে।
এরপর মাতুয়াইল, উত্তরা, শ্যামলী, যাত্রাবাড়ী, গাবতলী ও নয়াবাজার এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর মাতুয়াইলে পুলিশ ও বিএনপির কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা শুরু হয়। এতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের একপাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এর কিছুক্ষণ পর তিন যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
অন্যদিকে গাবতলী এলাকায় পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। বেলা ১১টা থেকে কর্মসূচি শুরু হলেও একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ত্রিমুখী সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান। পরে পুলিশ তাকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
এছাড়া রায় সাহেব বাজার এলাকা থেকে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদসহ ৮-১০ জনকে পুলিশ আটক করেছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
রাজধানীর আরেক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট উত্তরার বিএনএস সেন্টারের সামনে বেলা ১১টার দিকে জড়ো হতে থাকেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। এ সময় পুলিশ নেতাকর্মীদের বাধা দেয় এবং তাদের ওপর টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এতে করে বিমানবন্দর থেকে আব্দুল্লাহপুরমুখী সড়কে যান চলাচল দেড় ঘণ্টা বন্ধ থাকে। তবে বিএনপির কর্মীরা বলতে থাকেন, তারা সড়ক অবরোধ করবেন না। সড়কের একপাশে তারা অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন।
একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর শ্যামলীতেও। পুলিশের গাড়িতে আগুন ও একাধিক যানবাহন ভাঙচুর করা হয়েছে সেখানে। এছাড়া পুলিশের একটি গাড়িতেও আগুন দেওয়া হয়।
রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টের এসব সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে দেখা যায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদেরও। এভাবে দুপুর পর্যন্ত চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া।
পুলিশের সামনেই বাস-গাড়িতে আগুনের অভিযোগ
এদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর মাতুয়াইলে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। এরপর দুইটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর পৌনে ২টার দিকে হঠাৎ মাতৃসদন হাসপাতালের সামনে স্বদেশ পরিবহনের একটি বাসে আগুনের ঘটনা ঘটে। সেসময় বাসের ড্রাইভার মো. সানাউল্লাহ বলেন, তিনজন মোটরসাইকেলে করে এসে আমাকে মেরে বাসে আগুন ধরিয়ে চলে যায়। তাদের মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেট ছিল না। এ সময় পুলিশ পাঁচ-ছয় হাত দূরেই ছিল। এছাড়া রাস্তার দুই পাশেই পুলিশ ছিল।
এর কিছুক্ষণ পর দক্ষিণ মাতুয়াইলের সান্টু ফিলিং স্টেশনের সামনে যাত্রীবাহী আরও একটি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে দুপুর ২টার দিকে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এর আগে শুক্রবার মহাসমাবেশ করে শনিবার রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। পাল্টা কর্মসূচিও দেয় আওয়ামী লীগের সহযোগী তিন সংগঠন। তবে পুলিশের পক্ষ জানানো হয়, শনিবার কাউকে কর্মসূচি করতে দেওয়া হবে না। এরপর আওয়ামী লীগ কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিলেও সকাল সাড়ে ৯টায় বিএনপি, যুগপৎ দলগুলো অবস্থান কর্মসূচি করার কথা জানায়।
৬টি বাস ও পুলিশের গাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করেছে বিএনপি : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
বিএনপি আজ ছয়টি বাস ও পুলিশের গাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করেছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, নবীনগরে বিএনপির কোনো কর্মসূচি ছিল না, সেখানেও তারা বাসে আগুন ধরিয়েছে।
সংঘর্ষের ঘটনায় আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের মন্ত্রী বলেন, সব জায়গা থেকে বিএনপির নেতারা অগ্নি-সন্ত্রাসের জন্য উৎসাহ দিচ্ছেন। আমরা এর তীব্র নিন্দা প্রকাশ করছি।
রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে মন্ত্রী আরও বলেন, আহতদের মধ্যে ৩১ জন পুলিশ সদস্য রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আরও কয়েকটি হাসপাতালে আহত কয়েকজন পুলিশ সদস্য চিকিৎসা নিয়েছেন। অতিরিক্ত ডিআইজি মেহেদির ওপর বৃষ্টির মতো ঢিল ছোড়া হয়। কিন্তু তার বদলে যে একটা রিভেঞ্জ নেওয়া, সেটি কিন্তু তিনি বা পুলিশ করেনি। নীরবে তারা সহ্য করেছেন এবং তাদের পিছু হটতে বাধ্য করেছেন।
তিনি বলেন, আমরা সব সময় দেখেছি পুলিশ কখনো তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পেছনে ফিরে না। নিহত হবেন নাকি আহত হবেন– এসব বিষয়ে পুলিশ ভাবে না। জঙ্গি দমন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা তা দেখেছি। আজও পুলিশ বীরত্বের সঙ্গে সন্ত্রাস মোকাবিলা করেছে।
রোববার সারাদেশে বিক্ষোভের ডাক আওয়ামী লীগের
রাজধানীতে বিএনপি নৈরাজ্য ও অগ্নিসন্ত্রাসের প্রতিবাদে সারাদেশে আগামীকাল রোববার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিক্ষোভ ও সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ।
শনিবার (২৯ জুলাই) বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের জরুরি সভায় এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, আগামীকাল সারাদেশে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হবে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তর শাখার প্রতিটি থানায় বিক্ষোভ করা হবে।
একদিন পর সোমবার সারাদেশে বিএনপির সমাবেশ
অবস্থান কর্মসূচিতে হামলা ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে আগামী ৩১ জুলাই (সোমবার) সারাদেশের সব মহানগরে সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। এক সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, আমরা আগামীকাল রোববার (৩০ জুলাই) কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু জানতে পেরেছি- আগামীকাল আওয়ামী লীগ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে। তাদের মতো একই দিনে কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে সংঘাত চায় না আমরা। যার কারণে ৩১ জুলাই কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দিয়েছি।
এনএম/এমজে